ভূতুড়ে জাহাজ

দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান

সমগ্র পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে সমুদ্র। আছে সাগর-উপসাগর, মহাসাগরের বিশাল জলরাশি। অর্থনীতি, যোগাযোগ বা বাণিজ্যক্ষেত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো নৌপথ। সাগরের বুকে ভেসে চলে অসংখ্য জাহাজ। দিনের পর দিন নাবিকরা সমুদ্রের অতল জলে ভাসতে থাকেন জীবিকার সন্ধানে।

মানুষের বিচরণের মাঝে সমুদ্রে ঘটে যায় নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। অসংখ্য স্মৃতিকথা ছড়িয়ে আছে সাগরের বুকে। কত জাহাজের যে সলিল-সমাধি হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সেগুলোকে ঘিরে রচিত হয়েছে নানা কল্পকাহিনী। মানুষের মনে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন গুজব। ভূতুড়ে জাহাজ, সামুদ্রিক দানব, জলপরীসহ অসংখ্য রটনা প্রচলিত আছে সমুদ্রকে ঘিরে।

এমন একটি গল্প প্রচলিত দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান নামক তথাকত্থিত ভূতুড়ে জাহাজ নিয়ে। এটি ইউটিউব, ফেসবুক তথা ইন্টারনেট দুনিয়ায় বহুল প্রচলিত একটি মিথ।

এই জাহাজের কল্পকাহিনী মূলত অনেকটা এরকম-

এটি এমন একটি জাহাজ, যা বিরতিহীনভাবে সমুদ্রের বুকে ঘুরে বেড়ায়। ঠিক ঘুরে বেড়ায় বললে ভুল হবে, বলা যায় উড়ে বেড়ায়। কারণ লোকেরা জাহাজটিকে জলের স্পর্শ ছাড়া আকাশেই ভেসে থাকতে দেখেছে।অনেক নাবিকই তাদের সমুদ্রযাত্রায় এমন উড়ন্ত জাহাজ দেখার কথা উল্লেখ করেছেন। এজন্য এই কল্পিত নৌযানের নাম দেয়া হয়েছে দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান। বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসেও অনেকবার জাহাজটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এই মিথ মূলত শুরু হয় সতেরো শতকের দিকে, যখন নৌপথে বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা গড়ে উঠে। ব্রিটিশ বা ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে তখন সমুদ্রপত্থে বিভিন্ন দেশে যাত্রা শুরু করে। সমুদ্র হয়ে উঠেছিল জাহাজের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। সেই সময় থেকে মানুষ এই উড়ন্ত জাহাজের দেখা পেতে শুরু করে। তখন থেকেই সেটি সবার কাছে ভুতুড়ে জাহাজের তকমা পায়। নাবিকদের দেখা দৃশ্যগুলো আরো অতিরঞ্জিত হয়ে ছড়িয়ে যায় নানান গালগল্প। জাহাজটিকে অভিশাপের বার্তা কিংবা মৃত্যুদূত হিসেবে দেখতে শুরু করে সবাই। 

সমুদ্রে নাবিকরা আসলেই কি কোনো জাহাজকে উড়তে দেখতে পেত? এটা কি কোনো স্মৃতিভ্রম, নাকি নেহাতই ছড়ানো গল্প? অনকে নাবিকই সমুদ্রপথে তাদের এমন অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেছেন৷ কাজেই আর যাই হোক, এমন কোনো দৃশ্য তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন। কিন্তু কীভাবে? কোনো জাহাজ উড়ে বেড়ায় কী করে? তবে আসলেই কি ভূতুড়ে জাহাজের অস্তিত্ব আছে?

বিজ্ঞান বলে, ভূত-প্রেত বা অভিশপ্ত আত্মাজাতীয় কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্যে বেশিরভাগ ভূতুড়ে ঘটনার পেছনের বাস্তবতা ব্যাখ্যা করা যায়। এক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। এই জাহাজ দেখার ব্যাখ্যায় কাজ করে অপটিক্যাল ফিজিক্স। 

ফ্লাইং ডাচম্যান আসলে অনেকটা মরুর মরীচিকার মত। মরীচিকা কেন সৃষ্টি হয় তা সম্পর্কে সবাই নিশ্চয়ই কম-বেশি জানি। এর জন্য দায়ী আলোকরশ্মির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যাকে আমরা বলি পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন। 
আলো ঘন মাধ্যম থেকে হালকা মাধ্যমে যখন প্রবেশ করে, তখন কিছুটা বেঁকে যায়। এই ঘটনাকে বলা হয় আলোর প্রতিসরণ। আলোকরশ্মি যে তলের উপর আপতিত হয় তাকে বলা হয় বিভেদতল। বিভেদতলের উপর যে বিন্দুতে রশ্মির আপতন ঘটে তার নাম আপতন বিন্দু। সেই বিন্দু থেকে নির্দিষ্ট কোণে রশ্মি অন্যদিকে সরে যায়। ফলে আপতন ও প্রতিসরণ রেখার সমন্বয়ে একটি কোণ উৎপন্ন হয়। মাঝামাঝি আপতন বিন্দুতে একটি লম্ব আঁকা হয়, একে বলা হয় অভিলম্ব। অভিলম্বের সাথে আপতিত ও প্রতিসরিত রশ্মির কোণকে যথাক্রমে আপতন কোণ ও প্রতিসরণ কোণ বলে। 

আপতন কোণের বিভিন্ন মানের জন্য প্রতিসরণ কোণের মানও আলাদা আলাদা হয়। নির্দিষ্ট একটি মান পর্যন্ত কোণের মান সূক্ষ্মকোণ হয় অর্থাৎ প্রতিসরিত রশ্মি পুনরায় একই মাধ্যমে ফিরে আসে না। প্রতিসরণের দরুণ অভিলম্ব থেকে দূরে সরে যায়৷ আপতন কোণের যে মানের জন্য প্রতিসরণ কোণ সমকোণ হয়, অর্থাৎ প্রতিসরিত রশ্মি বিভেদতল ঘেঁষে চলে যায় সেটার নাম সংকট কোণ বা ক্রান্তি কোণ। যদি কোনো রশ্মি ক্রান্তি কোণের চাইতে বড় কোণে বিভেদতলে আপতিত হয়, তখন তা আবার প্রথম মাধ্যমেই ফিরে আসে। এই ঘটনাকে আমরা বলি পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন। এর কারণে ঘন মাধ্যমেই বস্তুটির একটি প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়।

মরীচিকার সৃষ্টি এ কারণেই। মরুভূমিতে মাটির কাছাকাছি বায়ু অধিক উত্তপ্ত ও হালকা থাকে। উপরের ঘন মাধ্যম অর্থাৎ ভারী বাতাস থেকে আলোকরশ্মি আপতিত হয়ে সেখানে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন ঘটায় এবং মরীচিকা তৈরি করে। গাছের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, ফলে মনে হতে পারে সেখানে কোনো পানির উৎস রয়েছে। 

সমুদ্রের পানির উপরে জাহাজ ভাসতে দেখার ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরনের পদ্ধতি কাজ করে। যে উড়ন্ত জাহাজ নাবিকরা দেখেন সেটা আসলে দূরের কোনো জাহাজের প্রতিবিম্ব, মরীচিকার মতোই। তবে এক্ষেত্রে সমুদ্রপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু অধিকতর শীতল ও ঘন হয়। জাহাজের অবস্থান থাকে ঘন মাধ্যমে। সেখান থেকে আলোকরশ্মি উপরের হালকা মাধ্যমের দিকে যাওয়ার সময় ক্রান্তি কোণের চেয়ে বেশি কোণে আপতিত হলে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন সংঘটিত হয় এবং জাহাজ হতে একটু দূরে হাওয়ায় জাহাজের একটি প্রতিবিম্ব ভেসে উঠে।

আসল জাহাজ দৃষ্টির অন্তরালে থাকলেও নাবিক প্রতিসরণের দরুণ বাতাসে ভাসমান জাহাজের মরীচিকা দেখতে পায় এবং ভাবে হাওয়ায় কোনো সত্যিকারের জাহাজ ভেসে আছে।
এই ঘটনাকে বলা হয় Fata Morgana.

অর্ত্থাৎ এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং আলোর কারসাজি।

সমুদ্রের বুকে এই দৃশ্যটিই যাত্রীদের চোখে ভয় ধরিয়ে দেয়। কারণ তারা সেটিকে আসল জাহাজ মনে করেন, এবং বাতাসে ভাসতে দেখে বিস্মিত হন। যার ফলাফল ফ্লাইং ডাচম্যান নিয়ে রটানো কাহিনীগুলো। 

এই পৃথিবীতে যত ভৌতিক ঘটনা ঘটে, প্রত্যেকটির পেছনেই লুকিয়ে থাকে বিজ্ঞান। প্রতিনিয়তই অলৌকিক অ্যাখ্যা পাওয়া নানা ঘটনার যথাযথ ব্যাখ্যা উদঘাটিত হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। ফ্লাইং ডাচন্যান তারই একটি উদাহরণ। যদিও ইন্টারনেটে এই গুজব এখনও ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তবে মানুষও সচেতন হচ্ছে এবং সত্যিটা জানছে।  

নিশ্চয়ই একদিন দূরীভূত হবে সব কুসংস্কারের মরীচিকা, বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে সমস্ত পৃথিবী। ভেসে চলবে কেবল বিজ্ঞানের জাহাজ, সকল অপবিজ্ঞান আর কু-রটনাকে ডুবিয়ে দিয়ে।


Reference-





Post a Comment

Previous Post Next Post