কৃত্রিম আক্ষেপ

কৃত্রিম আক্ষেপ

১.
সকাল সাড়ে সাতটা।

মায়ের সাথে বসে আছে  নিহাল।
ফুড ব্রেকের সময় হয়েছে।

- মা, ফুডক্যামোর নতুন ফ্লেভার এসেছে, জানো?
নিহাল হলোফোনের স্ক্রিনে চোখ দেয়।

- হ্যাঁ।
- প্লিজ মা, ওটা আনিয়ে নাও  না।
- হুম, ভাবছি নতুন ফ্লেভারটা যোগ করে নেবো। রোবোশপ থেকে অর্ডার করতে হবে।
ওরা খুব দারুণ সার্ভিস দেয়, ড্রোন এসে একেবারে বাসায় দিয়ে যায়।

- থ্যাংক ইউ মা, মাই গুড মাম্মি।
- আচ্ছা, এখন যাও স্টাডি রুমে। তোমার ক্লাসের সময় হয়ে আসছে। রেডি হয়ে বসো।

২.
- গুড মর্নিং এভরিওয়ান।
- গুড মর্নিং ম্যাম।

হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে নিশিতা ম্যামের ছবি ভেসে উঠেছে।
নিহালের সবচেয়ে পছন্দের টিচার। নিশিতা ম্যামকে সবাই খুব পছন্দ করে।
উনার প্রেজেন্টেশন অসাধারণ। ভদ্রমহিলা দারুণ পড়ান। হলোগ্রাফিক লেসনে উনার জুড়ি নেই।

- ওকে স্টুডেন্টস, আজকে আমাদের টপিক কী, দেখেছ সবাই?
বড় বড় অক্ষরে কিছু লেখা ভেসে উঠল। 

Cuisine of our ancestors.

- আমরা আজকে আমাদের পূর্বপুরুষদের খাবার এবং রান্না সম্পর্কে জানব।
বেশিরভাগ সময় বাংলিশে পড়ালেও মাঝে মাঝে নিশিতা ম্যাম চমৎকার বাংলা বলেন।

- তোমরা কি জানো, আমাদের পূর্ববতী মানুষদের ক্ষুধার অনুভূতি কেমন ছিল? তোমরা তো জানোই সকল জীবেরই এনার্জির দরকার হয়। আর এর জন্য তারা খাবার খায়। আমরা ঠিক যে কারণে ফ্লেভার নেই, একই রকম অনুভূতি ওদেরও ছিল। ক্ষুধার অনুভূতি। ক্ষুধা নিবারণের জন্য তারা কী কী করতো, জানো?

- কী, ম্যাম?

- ওদের স্টমাক নামে একটা অর্গান ছিল। বাংলায় সেটাকে বলা হতো পাকস্থলী। অনেকটা আমাদের এই ক্রোনোটামির মতোই।
রক্ত-মাংসের তৈরি সেই জিনিসটাই তাদের ক্ষুধার জানান দিত। কিছু সময় পর পর পূর্ণ করতে হতো সেটাকে। ওরা ওদের মুখে কিছু বস্তু প্রবেশ করাত, সেগুলোই ছিল তাদের খাবার।  খাবারগুলো তারা পেত গাছ কেটে, বা কোনো জীবকে মেরে।

সবাই আঁতকে উঠে। কী বর্বর ছিল ওরা!

- খাবার একটি নালি দিয়ে স্টমাকে চলে যেত। এই প্রসেসটাকেই তারা বলত "খাওয়া।"
খুব বেশিক্ষণ ধরে ক্ষূধার্ত থাকলে তাদের ব্রেইনে সব উল্টোপাল্টা সিগন্যাল যেত। তারা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ত।

নিহাল অবাক হয়।

- কোনো বস্তু স্টমাকে সোজাসুজি দিলেই চলত না। সেটাকে আবার খাওয়ার উপযোগী হতে হতো। আমরা যেমন ফুডক্যামো থেকে ফ্লেভার নেই, ওরা তেমন কিছু করতে পারত না। খাবারগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে, তাপে গরম করে খাওয়ার উপযোগী করত। নাহলে সেসব খাবার খেতে পারত না তারা।

- তো, ওরা শুধু খেতেই থাকতো? এত জিনিস কোথায় যেত?

- না, না, এজন্যই ওদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো। তাদের বায়োলজিক্যাল শরীর খাবারগুলোকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারতো না। সেগুলোর কিছু অংশ কাজে লাগত, আর বাকিটা শরীর থেকে বের করে দিতে হতো। ভীষণ দুর্গন্ধযুক্ত তরল আর কঠিন পদার্থের আকারে বেরুতো ওগুলো। বের করার জন্য আবার কিছু সময় পর পর ওদের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে হতো। 

ইন্টারেস্টিং তো!

৩.
দুপুর ১.৩০।

নিহাল আবার টেবিলে বসেছে।
ফুড ব্রেকের সময় হয়েছে।
- মা, নিশিতা ম্যাম আজ কী পড়িয়েছে জানো? অ্যান্সেস্টরদের কুইজিন।

- ইন্টারেস্টিং ছিল?
- হ্যাঁ,
তুমি জানো মা? আগেকার মায়েরা কী করত? ওরা আমাদের মত ক্যামোফুড নিতে পারত না।
ওরা কিছু জিনিসকে আগুনে পুড়িয়ে, তাপ দিয়ে সিদ্ধ করত। সেগুলো নাকি খুব টেস্টি ছিল, মা। ওরা নিজের মায়ের বানানো খাবার খেত। মায়ের বানানো খাবার, ইন্টারেস্টিং না মা?
তুমি আমার জন্য একটা ফ্লেভার বানাবে, মা? আমি তোমার বানানো ফ্লেভার নেবো। আমিও ওদের মত মায়ের বানানো ক্যামোফুডের টেস্ট নিতে চাই।

- পাগলামি করো না নিহাল, আমি কি ফুড ইঞ্জিনিয়ার? এসব কাজের জন্য তো তারা আছে। এসব বাজে চিন্তা বাদ দাও মাথা থেকে। আগেকার জিনিসের চিন্তা করো না। ওসব আর ফিরে আসবে না।
এর চাইতে একটা কাজ করো, ফুডক্যামোর নতুন যে যে ফ্লেভার এসেছে, ওগুলো অ্যাড করে নাও। টেস্টি হবে নিশ্চয়ই।
আচ্ছা আমি যাই তাহলে, ক্রোনোসেন্সর কিছুদিন ধরে ঝামেলা করছে। সার্জনের অ্যপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।

৪.
বিকেল চারটা।

নিহাল জানালার ধারে বসে আছে। উদাস মনে ভাবছে সে। 
ফটোল্যাম্পের কৃত্রিম রোদে ওর পলিমার স্কিন চকচক করছে।

ওর মন খুব খারাপ, নিউরাল মাইন্ড উল্টোপাল্টা সিগন্যাল দিচ্ছে।
মন খারাপের সংকেত।
সাইবর্গরা এটাকে মন খারাপই বলে।

ওর মাথায় ঘুরছে ছয়শ বছর আগের একটা প্রাচীন গ্রহের কথা। যেখানে একসময় ওদের পূর্বপুরুষ স্যাপিয়েন্সরা বাস করত।
স্যাপিয়েন্সরা জৈবিক সত্ত্বা ও অনুভূতির অধিকারী ছিল। ওরা নশ্বর ছিল। বেঁচে থাকার জন্য অনেক কাজ করতে হত তাদের, যা এখনকার সাইবর্গরা কল্পনাও করতে পারে না।
ধীরে ধীরে সেই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করেছে তারা, সাইবর্গ হয়ে উঠেছে। সাইবর্গরা স্যাপিয়েন্সদেরই উত্তরসূরি।

নিহাল হলোবুকে ওদের সম্পর্কে পড়েছে। নিশিতা ম্যামের ক্লাসেও জেনেছে অনেক কিছু।

স্যাপিয়েন্সদের জীবন সহজ ছিল না, প্রকৃতির কাছে তারা ছিল বাধ্য। আজ ওদেরই উত্তরসূরি সাইবর্গরা প্রকৃতিকে জয় করেছে, পুরো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে।

নিহাল তবু ভাবে, সেই সময়টাই ভালো ছিল। সে একটু আগে পড়েছে তখনকার মায়েরা নিজ হাতে বাচ্চাদের খাওয়াত। সব কাজ করে দিত, অনেক যত্ন নিত। নিহালের মার ওর দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসত নেই। ফুড ব্রেকের সময়টা ছাড়া দিনে তার সাথে তেমন দেখাই হয় না। ব্রেকের সময় তিনি জেট এলিভেটরে করে আসেন, আবার ওয়ার্কপ্লেসে চলে যান। তার মা অনেক বড় পদে আছেন। সারাদিন অফিসেই কাটে তার।

অবশ্য দেখার দরকারও হয় না। সাইবর্গরা স্বতন্ত্র, স্বাধীন। তারা একাকী থাকতে পারে।

নিহালের মন আরো খারাপ হয়। 
তার নিউরাল মাইন্ডে সিগন্যালের নয়েজ তৈরি হয়। স্যাপিয়েন্স হওয়ার ইচ্ছা জাগে তার মনে।
সে জেনেছে স্যাপিয়েন্সদের ভালোবাসা নামক অদ্ভূত অনুভূতি ছিল, যেটার মাধ্যমে তারা মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই এক দৃঢ় বাঁধনে জড়িয়ে থাকত। ওদের মায়েরা নিহালের মায়ের মত এমন দূরে দূরে থাকত না।

নিহালের সেই অনুভূতি নেওয়ার ইচ্ছা জাগে। তার ইচ্ছা জাগে মায়ের সাথে বসে গল্প করতে, মায়ের হাতে তৈরি করা ফ্লেভারের স্বাদ নিতে। নিহাল জানে সেটা সম্ভব নয়।
কৃত্রিমতায় ভরে আছে চারপাশ।

ওর মাইন্ডে নয়েজ বাড়তেই থাকে।

কৃত্রিম গ্রহের কৃত্রিমতার মধ্যে বসবাসকারী কৃত্রিম মানবের কৃত্রিম মস্তিষ্ক হঠাৎ এক কৃত্রিম নিখুঁত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আসে।

সবই কৃত্রিম, নিউরাল ব্রেইনের গোলযোগ, উল্টোপাল্টা সিগন্যাল। 

2 Comments

Previous Post Next Post