রাজ শকুন
শকুন।
শব্দটি শুনলে চোখে ভেসে উঠে কিছু ভয়ংকরদর্শন পাখির ছবি। তীক্ষ্ম ঠোঁটে মাংস খুবলে খাওয়ার দৃশ্য। কারো কারো চোখে সেই দৃশ্য রীতিমত বীভৎস মনে হয়। মানুষ তাদেরকে অপয়া, অশুভ, মন্দের প্রতীক ইত্যাদি অপবাদ দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি জানে, এরা প্রকৃতির কেমন গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোনো প্রাণীর মৃতদেহ কোথাও পড়ে থাকলেই কোথা থেকে যেন হাজির হয় এরা। দলবেঁধে দ্রুত সাবাড় করে মৃতদেহ।
প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর দায়িত্ব পালন করা শকুনদের দেখা এখন আর সহজে পাওয়া যায় না। ক্রমাগত বন উজাড় ও গাছপালা কর্তনের ফলে উপকারী পাখিগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। সমগ্র বিশ্বেই শকুন বর্তমানে বিপন্ন প্রাণী, তন্মধ্যে কিছু প্রজাতি মহাবিপন্নের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। রাজ শকুন তাদের মধ্যে অন্যতম।
পৃথিবীতে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। যাদের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৬ প্রজাতির শকুন রয়েছে। রাজ শকুন এর মধ্যে একটি মহাবিপন্ন প্রজাতি। International Union for Conservation of Natiure বা IUCN কর্তৃক এদেরকে Red list এ বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ১৯৭৪ এবং ২০১২ এর তফসিল ১ অনুযায়ী বাংলাদেশে মহাবিপন্ন ও সংরক্ষিত প্রাণীর তালিকায় রয়েছে এরা। একসময় পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও রাজ শকুনের দেখা মিলত। এখন আর এদের দেখা পাওয়া যায় না। আমাদের দেশ থেকে এরা প্রায় বিলুপ্তই বলা চলে।
শ্রেণিবিন্যাস :-
বাংলা নাম : রাজ শকুন।
ইংরেজি নাম : Red-headed Vulture.
বৈজ্ঞানিক নাম : Sarcogyps calvus.
জগৎ : Animalia
পর্ব : Chordata
শ্রেণি : Aves
বর্গ : Accipitriformes
পরিবার : Accipitridae
গণ : Sarcogyps
প্রজতি : S. calvus
অন্যান্য শকুনের তুলনায় রাজ শকুনের বর্ণ ও গড়নে চোখে পড়ার মত পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এদের চিহ্নিত করা খুব একটা কঠিন নয়। দেখতে বড় আকৃতির এই শকুনের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৭৬-৮৬ সেন্টিমিটার এবং প্রসারিত ডানা প্রায় ১৯৯-২৬০ সেন্টিমিটারের মত হয়। এদের ন্যাড়া মাথায় সুস্পষ্টভাবে লাল বা কমলা রং দৃশ্যমান। গলা ও ঘাড় কুঁচকানো লাল চামড়ায় আবৃত থাকে। চামড়ার উপর ছোট কালো পশম রয়েছে। বুকে সাদা পালক দিয়ে ঢাকা, পিঠ কালচে, ডানা ও লেজ বাদামি কালো রঙের এবং পা ম্লান গোলাপি বর্ণের হয়ে থাকে। পুরুষ শকুনের চোখ কিছুটা সাদা এবং স্ত্রী শকুনের চোখ বাদামি রঙের হয়। বাঁকানো ঠোঁটে গোলাপি আভা দেখা যায়। অন্যান্য শকুনের তুলনায় এরা দেখতে অনেকটা সুন্দর এবং সহজেই তাদের চেনা যায়।
রাজ শকুন প্রধানত শবভোজী। যেকোনো প্রজাতির প্রাণীর মৃতদেহ ভক্ষণ করে তারা। তীক্ষ্ম দৃষ্টিশক্তি রয়েছে তাদের। সচরাচর মাটি হতে ২৫০ থেকে ৩০০ মিটার উপরে বিচরণ করে এরা। এত উপরে থেকেও তীক্ষ্ম দৃষ্টির ফলে সহজে যেকোনো প্রাণীর মৃতদেহের সন্ধান পেয়ে যায়। দলবেঁধে ছুটে আসে মৃতদেহ ভোজনে। এছাড়া শামুক, পাখির ডিমসহ নানান সরীসৃপও এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে।
দেখতে ভয়ংকর মনে হলেও পাখিগুলো খুবই নিরীহ। চুপচাপ ভোজন সেরে চলে যায়। উঁচু গাছের ডালে সরু কাঠি দিয়ে বাসা বাঁধে তারা। সাধারণত একটিই ডিম পাড়ে এবং মাস দুয়েকের মধ্যে ডিম ফুটে ফুটফুটে বাচ্চা বের হয়।প্রাপ্তবয়স্করা দলবেঁধে আকাশে বিচরণ করে, খাওয়ার সময়ও একত্রে খাবার খায়।
বিরল প্রজাতির এই শকুনগুলো ইতমধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। অন্যান্য প্রজাতির শকুনদেরও এখন আর সচরাচর দেখা যায় না। বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ এবং খাদ্যের অভাবে শকুন বিলুপ্তির খাতায় নাম লিখিয়েছে। এদেশে আর কখনও হয়তো মিলবে না রাজ শকুনের দেখা।
References -
Tags:
জীববৈচিত্র্য