মরুভূমির চলন্ত পাথর

Sailing Stones 

অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ আপনি। নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ান। শখ জেগেছে বেয়ার গ্রিলস হওয়ার। হয়েই গেছেন অনেকটা, বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ঘুরে এসেছেন।

আপনার পরবর্তী গন্তব্য ডেথ ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়ার একটা জায়গা। অনেক দিন ধরেই সেখানে যাবার কথা ভাবছিলেন। শেষমেশ রওনা হয়েই গেলেন মৃত্যু উপত্যকার উদ্দেশে। জনমানবহীন হিমশীতল এক জায়গায় হেলিকপ্টার থেকে প্যারাসুট জাম্প করতে হলো আপনাকে। প্রায় সন্ধ্যা তখন। মাটিতে যখন নামলেন, ছয় ইঞ্চির পুরো বরফের চাদরের মধ্যে ঢুকে গেছে আপনার পা। ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছেন আপনি। এখন আপনার প্রথম কাজ হলো নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা, বেয়ার গ্রিলস স্টাইলে।

হাঁটা দিলেন সে উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই যে দৃশ্য দেখলেন তাতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আপনার। আপনার পেছনে ধাওয়া করছে একটা বস্তু। ধরতে আসছে আপনাকে। দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। সে কোনো জীব নয়। নির্জীব পাথরের মত দেখতে কিছু একটা। একটু কাছে এলেই স্পষ্ট দেখতে পেলেন।

হ্যাঁ, পাথরই।

ডেথ ভ্যালির সেই মৃত্যুসংবাদ বয়ে আনা অপয়া চলন্ত পাথর ধেয়ে আসছে আপনার পেছনে, আপনাকে পিষে দিতে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে দৌড়াতে শুরু করলেন আপনি, প্রাণপণ দৌড়। পাথরটা তখনও আপনার পিছু তাড়া করে চলেছে। হাত থেকে টর্চ পড়ে গেছে। অন্ধকারে কোনদিকে দৌড়াচ্ছেন ঠিক বুঝতে পারছেন না।
হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন কিছু একটায়।

সকাল হয়ে গেছে।
চোখেমুখে পানির ছিটেয় জ্ঞান ফিরল আপনার। আশেপাশে কিছু উৎসুক মুখ। রেসকিউ টিম এসেছে আপনাকে উদ্ধার করার জন্য। সারারাত অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন।
গত রাতের কথা মনে পড়তেই গা শিউরে উঠল আপনার।

আপনি ফিরতে পেয়েছেন মৃত্যু উপত্যকা থেকে। কিন্তু সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায় আপনাকে।  বিশাল পাথরের খন্ডের ধাওয়া করার দৃশ্য চোখে ভাসতেই আঁতকে উঠেন আপনি। পরে শুনেছিলেন অনেকেই সেখানে এমনটা হতে দেখেছে। কিন্তু সে রহস্যের কূলকিনারা আজও করতে পারেনি কেউ।

উপরের কাহিনী কোনো উপন্যাসের পাতা থেকে সংকলিত মনে হলেও এমন পাথর বাস্তবেই রয়েছে। আর সেগুলোকে নিয়ে প্রচলিত ছিল নানা কাহিনী, এমনকি আজও প্রচলিত আছে। ইউটিউবে বা অনলাইনে প্রচলিত মিথগুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি টপিক সেইলিং স্টোন বা চলন্ত পাথর।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ডেথ ভ্যালি নামক উপত্যকায় রেসট্র‍্যাক নামে একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। সেখানে দেখা মিলে চলন্ত পাথরের। পাথরগুলো কোনো কিছুর সংস্পর্শ ছাড়াই এগিয়ে যায়, রেখে যায় ছাপ। বিশাল লম্বা রেখার মতো সেই ছাপ দেখে অনুমান করা যায় কতটুকু পথ পাড়ি দিয়েছে এই পাথরগুলো।

কিন্তু এর পেছনের ব্যাখ্যা ঠিক কী? কেন নিজে থেকেই এগোয় পাথরগুলো? কে দায়ী এর পেছনে?
অলৌকিক কিছু? মোটেও না।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় আসা যাক।

প্রথমে ধারণা করা হতো পাথরগুলো শুধুমাত্র বাতাসের ধাক্কায়ই সামনে এগিয়ে চলে। কিন্তু এই হাইপোথিসিস যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ এত ভারী আর বড় পাথরের কোনোভাবেই শুধু বাতাসের ধাক্কায় মাটির ঘর্ষণ উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
অনেক দিন ধরে পাথরের এই এগিয়ে চলা মোটামুটি রহস্যের পর্দায় আবৃত থাকে। শুরুর দিকে কিছু গবেষণা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে ধোঁয়াশা থেকেই যায়।

সত্তরের দশকে সামনে আসে নতুন তথ্য। পাথরের রহস্য উদঘাটন করতে লেগে পড়েন দুই গবেষক, বব শার্প ও হুইট ক্যারে। ১৯৭২ সালের মে মাসে তারা "Racetrack stone movement monitoring program" চালু করেন। ত্রিশটি পাথর নিয়ে ছিল তাদের গবেষণা। প্রত্যেকটি পাথরকে তারা আলাদা আলাদা নাম দেন এবং পাথরগুলোর গতিবিধি দীর্ঘকাল ধরে পর্যবেক্ষণ করেন। প্রায় সাত বছরব্যাপী এই পর্যবেক্ষণ চলতে থাকে।

তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে উন্মোচিত হয় দীর্ঘদিনের রহস্য। দেখা যায়, পাথরগুলো গ্রীষ্মকালে কোনোরূপ স্থানান্তর প্রদর্শন করছে না। কেবল শীতেই তারা নড়াচড়া শুরু করে। ন্যান্সি নামের একটি পাথর প্রায় ৬৬০ ফুটের মত এগিয়ে যায়। এছাড়া পর্যবেক্ষণকৃত অন্যান্য পাথরগুলোও কম-বেশি দুরত্ব অতিক্রম করে। গতিবেগের দিক দিয়ে মিনিটে প্রায় দুই মিটারের মত পথও পাড়ি দিতে দেখা যায়।
কেন পাথরগুলো শুধু শীতকালেই যাত্রা করে? দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় এর রহস্য।

শীতের রাতে ডেথ ভ্যালির তাপমাত্রা শূন্যের কয়েক ডিগ্রি নিচে নেমে যায়। বৃষ্টি এবং তুষারপাত হয়। তীব্র ঠান্ডায় পাথরের নিচে মাটিতে তৈরি হয় কয়েক ইঞ্চি পুরু বরফের চাদর। দিনের বেলায় তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লে সেই পুরু বরফের চাদর গলতে থাকে। বরফগুলো প্লেট আকারে ভাঙতে থাকে এবং পিচ্ছিল হয়ে যায়। 
পাশাপাশি পাহাড়ি ঢল আসতে থাকে রেসট্র‍্যাকের দিকে। ফলে বরফের শিটগুলো অনেকটা পিচ্ছিলভাবে ভাসমান থাকে এবং মাটির সাথে ঘর্ষণ অনেকাংশে হ্রাস পায়। যার কারণে আর্দ্র ও ভারী বাতাসের ধাক্কা পুরু বরফের শিটগুলোকে গতিশীল করানোর শক্তি পায় এবং ধাক্কা দেয় পাথরগুলোকে। পিচ্ছিল বরফযুক্ত মাটিতে পাথরগুলো এই ধাক্কায় সহজেই এগুতে থাকে। এভাবেই এগিয়ে যায় পাথরগুলো।

এই ভিডিওতে ব্যাপারটি খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
দেখে নিতে পারেন - https://youtu.be/fMm1E8CYSxk

সত্তরের দশকের এই গবেষণার পর পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশক এবং ২০১৩-১৪ সালের দিকে পাথরগুলো নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা হয়। পাথরের চলাফেরার এই ব্যাখ্যা গভীর পর্যবেক্ষণ ও টাইমল্যাপস ভিডিওর মাধ্যমে আরো সুদৃঢ় হয়।

অন্যান্য সব প্রাকৃতিক রহস্যের মত ডেথ ভ্যালির চলন্ত পাথরের রহস্যেরও সমাধান হয়। কিন্তু এরপরেও বরাবরের মতই এ নিয়ে গুজবের শেষ নেই। পাথরগুলোকে নিয়ে অনেক গল্প ফাঁদা হয়েছে এবং তাতে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সচরাচর এমন ঘটনার পেছনে ভৌতিক বা অলৌকিক বিষয় দাঁড় করিয়ে গুজব প্রচার করা হয়। রহস্য- শিরোনামের যেকোনো ভিডিওতে চলমান পাথরের ঘটনা অবশ্যই দেখতে পাবেন।

মৃত্যু উপত্যকার চলমান পাথরের রহস্যের সমাধান হয়েছে। প্রতিনিয়ত আরো নানান রহস্যের পর্দা উন্মোচিত হচ্ছে। বেরিয়ে আসছে এসব ঘটনার পেছনে থাকা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। ভ্রান্ত ধারণার কুয়াশা দূর করে উদিত হচ্ছে সত্যের সূর্য। 

এভাবেই চলতে থাকুক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা।

[নোট-প্রথম অংশ নিতান্তই রূপক. পাথরগুলো কিন্তু মোটেও অত দ্রুতগতিতে চলে না। খুবই ধীরে চলে।]


References- 



Post a Comment

Previous Post Next Post