স্বপ্নাক্রান্ত

স্বপ্নাক্রান্ত


১.
অচেনা একটা জায়গা।
কেমন ভ্যাপসা, গুমোট অন্ধকার।

হাঁটু গেড়ে বসে আছে একজন মানুষ।
হাত দুটো পেছনে বাঁধা তার, মুখে কাপড়।
হাঁসফাঁস করছে সে, বাঁধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টায়।
মুখ দেখা যাচ্ছে মানুষটার।
লোকটা সে নিজেই।
তার দিকে তাক করে আছে একটা হাত।
সেই হাতে একটা রিভলবার।
ট্রিগারে চাপ।
কাপড় ভেদ করে ভেসে এল চাপা আর্তনাদ।
হাসির শব্দ।
তারপর সব নিশ্চুপ।

ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠল রুশেভ।
আজও সেই স্বপ্ন।
কয়েকদিন ধরে একই অদ্ভূত স্বপ্ন দেখছে সে।
ঘড়ির দিকে তাকায় রুশেভ।
রাত ৩.০০ টা।

অসহ্য!
কী হচ্ছে এসব?
যেন সে বাস্তবে অনুভব করছে। মনে হচ্ছে তাকে কেউ ভবিষ্যতের ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছে। একটু একটু করে তথ্য দিয়ে যাচ্ছে তাকে। সাবধান করতে চাইছে।
একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে।

এই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
পাগল করে দিচ্ছে।

এর রহস্য খুঁজে বের না করা পর্যন্ত শান্তি নেই।

২.
সকাল দশটা।

এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে রুশেভ। রাতের ভয়ানক দুঃস্বপ্নের পর অনেক দেরিতে ঘুম এসেছিল তার। ঘুমিয়ে সে সকাল পার করে ফেলেছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় রুশেভ। সকালের নাস্তা বানানোর সময় এখন নেই। তাকে দ্রুত যেতে হবে। আলমারিতে একটা কেকের প্যাকেট আছে, সেখান থেকে দুপিস কেক আর পানি খেয়ে নেয় ।দ্রুত বেরিয়ে পড়ে ল্যাবের উদ্দেশ্যে।

রুশেভ একজন পরিচিত সায়েন্টিস্ট। সে সুপরিচিত উদ্ভাবক। একেক পর এক অদ্ভূত আর চমকপ্রদ ডিভাইস তৈরি করে সারা পৃথিবীতে সুখ্যাতি অর্জন করেছে।

- গুড মর্নিং স্টুয়ার্ট।
- গুড মর্নিং স্যার, আজকে এত দেরি করে এলেন যে? সকালে অনেক বার ফোনে ট্রাই করেছিলাম।

- ফোনটা বোধহয় সাইলেন্ট ছিল। ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়েছে। যাই হোক, কাজ কতদূর এগোলো?
- প্রোগ্রেস অনেক ভালো। ব্লু-প্রিন্ট অনুযায়ী প্রায় সবকিছু অ্যাসেম্বল করা শেষ, শুধু অল্প কিছু ফাংশন অ্যাড করা বাকি আছে।

QNT.
কোয়ান্টাম নিউরোট্রান্সমিটার। 
রুশেভের স্বপ্নের প্রজেক্ট। একালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হতে যাচ্ছে এটা। পৃথিবী বদলে দেবে তার এই আবিষ্কার।
স্টুয়ার্ট এই প্রজেক্টে সহকারি হিসেবে কাজ করছে। সে তার একমাত্র অ্যাসিস্টেন্ট। ভীষণ মেধাবী আর  অনুরাগী ছেলে। আজ পর্যন্ত তার সব প্রজেক্টেই কাজ করেছে। ডিভাইসগুলো তৈরি হবার পেছনে স্টুয়ার্টের পরিশ্রম অনেক।

৩.
রাত ৩.০০।
আবার সেই একই স্বপ্ন। তবে আজ ভিন্ন কিছু দেখেছে রুশেভ। এখন তার কাছে সবই পরিষ্কার।

সে এতদিন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিল। কেউ একজন তাকে দেখাচ্ছিল এসব। তারই পরাবাস্তব জগতের সত্তা। রুশেভকে সে উপলদ্ধি করানোর চেষ্টা করছিল।

যে স্বপ্ন দেখে আসছে, তা আসলে স্বপ্ন নয়। সেটা তার ভবিষ্যৎ ছিল।খুনির মুখ দেখেছে সে। 

হুয়ান ক্রেসকো।
রুশেভের মতই বিখ্যাত উদ্ভাবক। তার তীব্র প্রতিন্দ্বন্দ্বী। ক্রেসকো আগে রুশেভের অনেক আইডিয়া চুরি করেছে। দুজনের মধ্যে অহি-নকুল সম্পর্ক।

কিউএনটি প্রজেক্ট রুশেভের স্বপ্ন। এর ফর্মূলা শুধু সে আর স্টুয়ার্টের কাছে আছে। ক্রেসকো সেটা সম্পর্কে জানার পর থেকে রুশেভের প্রজেক্ট ডিটেইলস চুরি করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সে স্টুয়ার্টকেও টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্টুয়ার্টের সততা আর একনিষ্ঠতা তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দেয়নি।

কিউএনটি তৈরি হলে পৃথিবী বদলে যাবে। ক্রেসকো যেকোনো মূল্যে তা নিজের করে নিতে চায়। 
সে এবার রুশেভকে মারার প্ল্যান করছে। তাকে নেরে সে কিউএনটির ফর্মূলা হাতাতে চায়।
রুশেভ ঠিক এটাই জানতে পেরেছে। পরাবাস্তব সত্তা তাকে ভবিষ্যতের ব্যাপারে সাবধান করেছে। কয়েকদিন ধরে সে স্বপ্নে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছিল। অপর সত্ত্বা আজ তাকে বলে দিয়েছে, ক্রেসকোকে মারতে হবে। সরিয়ে দিতে হবে পথের কাঁটা।

হাত মুষ্টিবদ্ধ করল রুশেভ। সে জানে তাকে এখন কী করতে হবে। ক্রেসকো মারার আগে সে মেরে ফেলবে ওকে। ঘোরের মত অনুভব করল রুশেভ। যেন কেউ তাকে সম্মোহিত করে রেখেছে, মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা কথা, যেটা তার কানে বাজছে বারবার। 

"ক্রেসকোকে মারতেই হবে।"

৪.
৩ নং উইলস্টন স্ট্রিট।
সদ্য ডিনার করে বিছানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্রেসকো।
কলিং বেল বেজে উঠে।
এত রাতে কে এলো?
দরজা খুলল সে।

- তুমি?

রুশেভ জবাব দেয় না। জোরে একটা ধাক্কা দেয় ক্রেসকোকে। ক্কিছু বুঝে উঠার আগেই ক্রেসকো দেখে রুশেভের হাতে একটা পিস্তল।

- কী করছো তুমি?
- চুপ! আমাকে মারবি তুই? সেই সুযোগ দেবো না তোকে। তুই এবার শেষ।
কিছু বলার আগেই ট্রিগারে চাপ দেয় রুশেভ।

দুটো বুলেট ঢুকে যায় সোজা বুক বরাবর। লুটিয়ে পড়ে ক্রেসকো।

৫.
সকাল দশটা।

পত্রিকায় বড় করে হেডলাইন বেরিয়েছে-
"শীর্ষ বিজ্ঞানী ক্রেসকো খুন। খুনের অভিযোগে আরেক শীর্ষ বিজ্ঞানী রুশেভ গ্রেফতার।"
নিউজের ডিটেইলসে লেখা, কাল রাতে নিজের ৩ নং উইলস্টন স্ট্রিটের বাসায় খুন হন ক্রেসকো। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করেছে। সিসিটিভিতে পরিষ্কার দেখা গেছে খুনিকে।
রুশেভ খুনের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কিছু অদ্ভূত কথা বলেছেন যা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেসব তথ্য তিনি দিচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে মামসিক বিকৃতি ঘটেছে তার। খুন করতে তাকে কেউ বাধ্য করেছে, এমন দাবি করছেন তিনি। কিন্তু সে কে, তা বলতে পারছেন না।
ধারণা করা হচ্ছে, পূর্বশত্রুতায় অন্ধ হয়ে তিনি এই কাজ করেছেন।

নিউজপেপারটা হাত থেকে নামিয়ে রাখল স্টুয়ার্ট। ক্রুর হাসি হেসে উঠল সে। পরিকল্লনা সফল হয়েছে।

রুশেভের সাথে সে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছে। দুজনে একসাথে মিলে করেছে সব। অথচ স্টুয়ার্ট কোনো ক্রেডিট পায় নি। সব কৃতিত্ব রুশেভ একাই নিয়ে নিয়েছে।

এবার যে প্রজেক্ট ছিল, তাতে স্টুয়ার্টের অবদান অনেক বেশি। অথচ এবারও সব ক্রেডিট নিতে যাচ্ছিল রুশেভ।
বীতশ্রুদ্ধ হয়ে পড়ে স্টুয়ার্ট। আর এমন হতে দেওয়া যাবে না।

সে একটা প্ল্যান করে।
কিউএনটির কৃতিত্ব রুশেভকে নিতে দেবে না। কী করা যায়?

রুশেভকে মারাও যাবে না। তাতে তার নিজেরই ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।
কোনো অপরাধে ফাঁসানো যায়। পথের কাঁটা সরে গেলে সব কৃতিত্ব নিজের করে নেবে স্টুয়ার্ট।

রুশেভের বিছানায় তার মাথার দিকে একটা হিপনোট্রান্সমিটার বসায় স্টুয়ার্ট।

রুশেভেরই একটা আবিষ্কার। স্টুয়ার্টের সাথে মিলে বানানো এই ডিভাইস সেবার বেশ সাড়া ফেলেছিল। সাইকিয়াট্রিস্টদের জন্য বিশেষভাবে বানানো এই যন্ত্র কনসালটেন্সির সময় রোগীদের সহজে হিপনোটাইজ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। আকারে অনেক ছোট হওয়ায় সহজেই চোখের অন্তরালে রাখা যায়। দূর থেকে রোগী মস্তিষ্কে বিভিন্ন ফ্রিকুয়েন্সির ওয়েভ ট্রান্সমিট করে মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলা যায়। 

এটাকে একটু মডিফাই করেছে স্টুয়ার্ট। অন্যসব ডিভাইসের মতো এর ব্লু-প্রিন্টও তার জানা। তাই কাজ করতে কোনো সমস্যাই হয়নি। কম্পিউটার সিমুলেশনের সাহায্যে বানানো একটা স্টোরি স্বপ্নের মতো একটু একটু করে ট্রান্সমিট করেছে রুশেভের ব্রেইনে। মিথ্যা স্মৃতি ঢুকিয়ে ক্রেসকোকে মারার জন্য উসকেছে।

স্টুয়ার্ট তৈরি হলো। পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে। মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে ডাকা হয়েছে তাকে। ক্রেসকোর সাথে রুশেভের শত্রুতার ব্যাপারে তার চেয়ে ভালো আর কে--ই বা জানে?  সেখানে সেগুলোকে সে আরো একটু রং মাখিয়ে বর্ণনা করবে।
এই ঝামেলা শেষ হলে কিউএনটির কাজ শেষ করবে সে। সব কৃতিত্ব হবে তার একারই।
পৃথিবী পরিচিত হবে নতুন এক জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সাথে।

জন এল স্টুয়ার্ট।

Post a Comment

Previous Post Next Post