গাঙ্গেয় ডলফিন
নদীর দেশ বাংলাদেশ।
দেশের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদী। এদেশের নদীগুলো প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদের আধার। নদীতে বিচরণ করে নানা প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে রয়েছে কিছু বিরল মৎস্যসম্পদ, যারা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
শুশুক তাদের মধ্যে একটি পরিচিত নাম।
ডলফিন আমাদের সবারই খুব প্রিয়। সমুদ্র বা নদী উপকূলে ডলফিনের মনোমুগ্ধকর জলকেলির দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়। আমাদের দেশেও রয়েছে নদীর ডলফিন, যার দেশীয় নাম শুশুক।পদ্মা, যমুনা, সুরমা, হালদা কিংবা রূপসার বুকে শুশুকেরা একসময় দাপিয়ে বেড়াত। এখন সহজে তাদের দেখা মেলা ভার। বাংলাদেশে শুশুক বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর খাতায় নাম লিখিয়েছে।
শুশুকের অসংখ্য প্রজাতি রয়েছে। এরা মূলত মিঠাপানির ডলফিন। বাংলাদেশে প্রধানত যাদের দেখা মেলে তারা গাঙ্গেয় ডলফিন বা South Asian River Dolphin. স্থানীয়ভাবে অনেক অঞ্চলে তারা হুম বা হচ্ছুম মাছ নামে পরিচিত। জেলেদের জালে ধরা পড়ে, কারেন্ট জালে আটকে, এবং নদী দূষণ সহ বিভিন্ন কারণে শুশুকের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। হারিয়ে যেতে বসেছে দেশের জীববৈচিত্র্য থেকে।
শ্রেণিবিন্যাস-
বাংলা নাম : শুশুক, হুম মাছ/হচ্ছুম মাছ, গাঙ্গেয় ডলফিন।
ইংরেজি নাম : Ganges river Dolphin/South asian river Dolphin.
জগৎ : Animalia
পর্ব : Chordata
শ্রেণি : Mammalia
বর্গ : Artiodactyla
পরিবার : Platanistidae
গণ : Platanistidae
প্রজাতি : P. gangetica
শুশুক দেখতে অনেকটা সাধারণ ডলফিনের মত হলেও দেহের গড়নে সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এদের পৃষ্ঠ পাখনা কিছুটা ছোট আকৃতির হয়, মুখে লম্বা চঞ্চুর মতো ঠোঁট থাকে। স্ত্রী শুশুক পুরুষের চেয়ে আকারে লম্বা। দেহের অন্যান্য স্বাভাবিক গঠন ডলফিনের মতই। ভালোভাবে লক্ষ না করলে সাধারণ দৃষ্টিতে আলাদা করা যায় না।
এদের জীবনধারণের পদ্ধতি বেশ বৈচিত্র্যময়। শুশুকের প্রধান খাদ্য মাছ বা চিংড়িজাতীয় প্রাণী। তাদের দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল, চলাচলের জন্য তারা ইকোলোকেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে। বাদুড়ের মতই এরা আল্ট্রাসনিক শব্দ উৎপন্ন করে এবং প্রতিধ্বনির সাহায্যে চলাচলের পথ বুঝতে পারে। শ্বাস গ্রহণ করার জন্য কিছু সময় পর পর পানির উপর ভেসে উঠতে হয়, কারণ ফুলকা নেই তাদের। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তারা শিস্ বাজায় এবং দলবদ্ধ হয়ে বিচরণ করে। শুশুকরা স্তন্যপায়ী প্রাণী, সাধারণত দু-তিন বছর পর পর বাচ্চার জন্ম দেয়। শিকার ধরার উপযোগী হয়ে উঠা পর্যন্ত বাচ্চারা মায়ের সাথেই থাকে। সাধারণত ২৬-২৮ বছর বাঁচে তারা।
কিউট এই প্রাণীটিকে বাংলাদেশের প্রায় সব বড় নদীতে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের নদীগুলোতেও এদের বসবাস রয়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এদের সংখ্যা কমে আসছে। কারেন্ট জালের ছোবলে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য শুশুক। তাদের ইকোলোকেশন সিস্টেম কারেন্ট জালের সুক্ষ্ম ফাঁক ধরতে পারে না। ফলে সামনে ফাঁকা আছে ভেবে তারা এগিয়ে যায় এবং কারেন্ট জালে আটকা পড়ে। এছাড়া অবাধে মাছ শিকার ও নদীতে নৌযান চলাচলের কারণে শুশুকের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য বিরল জীবদের মত শুশুকও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এদেশ থেকে। সরকারিভাবে শুশুক বাঁচানোর প্রাণপণ চেস্টা করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী আইন ২০১২ অনুসারে সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে এদের। সুন্দরবনের কিছু অঞ্চল এবং বড় নদীগুলোর কিছু অংশকে মৎস্য অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এরপরেও শিকার ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলাফলস্বরুপ, ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগুচ্ছে তারা।
এভাবে চলতে থাকলে বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাবে আরো একটি জীববৈচিত্র্য। হালদা-রূপসার বালুময় তীরে বসে আর দেখা যাবে না শুশুকের জলকেলি। তাদের লম্ফঝম্ফে আর প্রকম্পিত হবে না স্রোতস্বিনীর বহমান স্রোত।
References-
Tags:
জীববৈচিত্র্য