ডাহুক

ডাহুক

 
অবিশ্রাম ঝ’রে ঝ’রে পড়ে
শিশির পাখার ঘুম,
গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল
হ’য়ে আসে নিসাড় নিঝুম,
নিভে যায় কামনা চেরাগ;
অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক।
-ফররুখ আহমদ

গ্রামীণ প্রকৃতির সবুজ শ্যামল সৌন্দর্যের বার্তাবাহক পাখি ডাহুক।
গ্রামের বাতাস মুখরিত করে রাখা ডাহুকের সেই ধ্বনি কি শোনা যায় এখন? সন্ধ্যায় একটানা ডেকে চলা সুমধুর কন্ঠের গুঞ্জন কি আর ভেসে আসে?
অনিন্দ্য সুন্দর পাখি ডাহুকের বিরহী কন্ঠ এখন অনেকটা নিশ্চুপ। কদাচিৎ শোনা যায় ডাহুকের ডাক। হারিয়ে যাচ্ছে জসীমউদদীন, জীবনানন্দের কবিতায় স্থান করে নেয়া গ্রাম-বাংলার পরিচিত এই পাখিটি।

ডাহুক বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ পাখিদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। গ্রামে জলাশয়ের পাশে একসময় অবাধ বিচরণ ছিল ডাহুকের। পুকুর পাড়ে ডাহুকের দৌড় ছিল এক পরিচিত দৃশ্য। ডাহুকের সেই দৌড় এখন আর দেখা যায় না আগের মতো। তাদের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে বর্তমানে। অপূর্ব সুন্দর দেখতে পাখিটির ইংরেজি নাম White-Breasted Waterhen. এশীয় অঞ্চলের গ্রাম্য পরিবেশের খুব পরিচিত পাখি, গ্রামীণ জীবনের নিত্যসঙ্গী ডাহুক। তাই তো গ্রাম-বাংলার সাহিত্যে বারবার ডাহুকের কথা উঠে এসেছে। শৈশবের দুরন্ত স্মৃতিতে রয়েছে ডাহুক পাখির স্থান।

শ্রেণিবিন্যাস -

বাংলা নাম : ডাহুক, ডাউক, পানপায়রা।
ইংরেজি নাম : White-Breasted Waterhen.
জগৎ : Animalia
পর্ব : Chordata
শ্রেণি : Aves
বর্গ : Gruiformes
পরিবার : Rallidae
গণ :  Amaurornis
প্রজাতি : A. phoenicurus

ডাহুক দেখতে অনেকটা ছোটখাট মুরগির মত। এরা লম্বায় প্রায় ৩০ সেন্টিমিটারের মত হয়। মাথা ও বুক সাদা এবং কপাল কালো, পাখনা ও শরীরে ছাই-কালো রঙের পালক রয়েছে। খাড়া লেজের নিচের অংশে লালচে আভা দেখা যায়। দৌড়ানোর সময় লেজ নাচিয়ে দৌড়ায় তারা। এদের শক্ত মজবুত হলুদ ঠোঁটের উপরে লাল দাগ স্পষ্ট দৃশ্যমান। লিকলিকে পায়ের আঙুলগুলো লম্বা ও সবুজ বর্ণের।

যেকোনো জলাশয়ের ধারে ঝোপে বাসা বানিয়ে থাকে তারা। একটি ডাহুক দম্পতি একসাথে এক বাসায় থাকে।আষাঢ় ও শ্রাবণ ডাহুকের ডিম পাড়ার মৌসুম। এজন্য বর্ষাকালেই ডাহুকের সতর্ক কন্ঠ বেশি শোনা যায়। মা ডাহুক সাধারণত ৫-৭ টি ডিম পাড়ে। বাবা ও মা মিলে পালা করে ডিমে তা দেয়। ১৮-২০ দিন পরে ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে ফুটফুটে ছানা।

 
ডাহুকের প্রিয় খাবার জলজ পোকা-মাকড়। এছাড়া তারা ঘাসের কচি ডগা, ধান, শামুক বা শস্যদানাও খেতে পছন্দ করে। অন্যান্য পাখির ছানাদের মত খাবার মুখে  তুলে খাওয়াতে হয় না ডাহুক ছানাদের। জন্মের পরই মাটিতে নেমে বাবা-মার সাথে নিজেই খুঁটে খাবার খেতে শুরু করে তারা।

 
বাংলাদেশের নদ-নদী, বিল ও হাওরে প্রচুর পরিমাণে ডাহুকের বসবাস ছিল।পঞ্চগড় জেলায় ডাহুক নদী নামে একটি নদীও রয়েছে। যেখানে একসময় চরে বেড়াত ডাহুকের দল।
কিন্তু বাংলার মাটি থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ডাহুক। বিলুপ্তির শঙ্কায় বাংলাদেশ বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২ অনুযায়ী এদেরকে সংরক্ষিত প্রাণী ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও ঠেকানো যাচ্ছে না অবাধে ডাহুক শিকার। প্রকাশ্যে ডাহুক কেনা-বেচা করতে দেখা যায়। গ্রামের মানুষ সুযোগ পেলেই ডাহুক ধরে খায়। এভাবে ডাহুক ধরে ধরে খাওয়ার ফলে এদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। ক্রমশ কমে আসছে ডাহুকের সংখ্যা। প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ডাহুক।

প্রাচীন কবি চন্ডীদাস হতে আধুনিক কবি আল মাহমুদের কবিতায় স্থান করে নেয়া ডাহুক হারিয়ে যাচ্ছে এদেশ থেকে। ডাইনিং টেবিলে খাবারের প্লেটে খাবার হয়ে প্রকৃতির প্রতি মানুষের আগ্রাসনের সাক্ষ্য রেখে যাচ্ছে তারা।

হয়তো এমন দিন আসবে,
বিলের ধারে ভরদুপুরে দেখব না আর ছোট্ট ডাহুকের দৌড়, গোধূলির আবছা আলোয় পুকুরপাড়ে শুনব না আর ডাহুকীর বিরহী সুর।


References-






Photo Credits-

Post a Comment

Previous Post Next Post