প্রাচীন সমুদ্রের দানব হেলিকোপ্রিয়ন

The pre-historic Alien

Helicoprion

গভীর সমুদ্র।

অতল জলরাশির নিচে আপনি ডাইভ দিতে নেমেছেন। বেশ শৌখিন মানুষ আপনি, স্কুবা ডাইভিংয়ে যান প্রায়ই।আজও সমুদ্রে ডুবে দিয়েছেন। পৌছে গেলেন পঞ্চাশ ফুটেরও নিচে, যেখানে ভিজিবিলিটি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট-মাঝারি মাছ, অক্টোপাস, কচ্ছপ। হঠাৎ পানিতে একটা আলোড়ন অনুভব করলেন। লক্ষ করলেন, আপনার আশেপাশের প্রাণীগুলো কেমন যেন ভয়ার্ত হয়ে পালাচ্ছে। ডাইভিং লাইটের আবছা আলোয় সামনে বিশাল এক জীব দেখতে পেলেন আপনি। প্রাণীটার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে ও ভয়ে আপনার চোয়াল হা হয়ে গেল। কারণ তার মুখে বসানো আছে আস্ত একটা করাত। লোহা কাটার জন্য যেমন গোলাকৃতির করাত ব্যবহার করা হয়, ঠিক তেমন দেখতে একটা করাত, বিশাল সাইজের।
সে এগিয়ে আসছে আপনার দিকে, তার লক্ষ্য আপনার মাথা। একটু পরই হয়তো সেই করাতের ধারালো ব্লেড বসবে আপনার গলায়।

সিনেমার দৃশ্য মনে হচ্ছে? বাস্তবে এই দৃশ্য দেখা তো দূর, এমন প্রাণী কল্পনা করাও দুষ্কর। কিন্তু এই ঘটনাই হয়তো আপনার কাছে স্বাভাবিক হতো, যদি আড়াইশ মিলিয়ন বছর আগের পার্মিয়ানের গভীর সমুদ্রে ডাইভে যেতেন।

পরিচিত হোন এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রি-হিস্টোরিক জীবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময়দের অন্যতম, Helicoprion এর সাথে।

১৮৯৯ সাল।
রাশিয়ান প্যালাসিওন্টোলজিস্ট আলেকজান্ডার কার্পেনস্কি রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটা ফসিল স্পেসিমেন খুঁজে পেলেন। যেটা দেখতে অনেকটা প্রাচীন ডেভোনিয়ান যুগের সেফালোপড (শামুক জাতীয় জীব) অ্যামোনাইটের খোলসের মত। প্রথমে সেটাকে অ্যামোনাইটই ভাবা হচ্ছিল।কিন্তু পরে আরো পর্যবেক্ষণের পর দেখা গেল সেটা আসলে অ্যামোনাইট নয়, দাঁতের তৈরি চোয়ালের মত কোনো স্ট্রাকচার। বিষয়টা অবাক করার মত, কারণ এর আগে কোথাও এমন স্পাইরাল ব্লেড আকৃতির চোয়াল দেখতে পাওয়া যায়নি।

        Helicoprion Tooth Fossil 

দুটো ধারণা ছিল ফসিলটির সম্পর্কে।
১. আসলেই এটি কোনো প্রাণীর চোয়াল, যেমনটা কেউ কখনো আগে দেখেনি। অথবা,
২. এটা কোনো বড় শার্কজাতীয় জীবের Dorsal fin (পৃষ্ঠ পাখনা) এ থাকা স্পাইন হতে পারে। অনেক জীবে এরকম স্পাইন দেখা যায়।

              Ammonite Fossil

এভাবে ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে অনেকগুলো দশক কেটে যায়। ততদিন পর্যন্ত প্যালাসিওন্টোলজিস্টরা  সুনিশ্চিতভাবে কোনো ধারণা দিতে পারেননি। ক্রমান্বয়ে রাশিয়া, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে আরো কিছু পরিপূর্ণ  ফসিল পাওয়া যায়, যা থেকে ফসিল বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হন প্রথমে পাওয়া ফসিলটি পার্মিয়ান যুগের কোনো দানবের দাঁতের ফসিল ছিল। প্রাণীটির নাম দেয়া হয় Helicoprion. এমন এক প্রাণী, যার চোয়াল ছিল আস্ত একটা করাত, আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত যা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। পরবর্তীতে অবশ্য এই ধরনের আরো কিছু প্রজাতি আবিষ্কৃত হয় যাদের দাঁতের গঠন এদের সাথে মিলে। সব প্রাণী একই ফ্যামিলির অন্তর্গত - নাম Helicoprionidae। এরা সবাই একটি ইউনিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যাকে বলা হয় Tooth whorl বা করাত আকৃতির চোয়াল। তাদের মধ্যে হেলিকোপ্রিয়নের দাঁতের গঠন সবচেয়ে অনন্য ও ভয়ংকর।

শ্রেণিবিন্যাস-

Kingdom : Animalia
Phylum : Chordata
Class :Chondrichthyes
Order :Eugeneodontida
Family :Helicoprionidae
Genus : Helicoprion

ফসিল রেকর্ড থেকে জানা যায় এরা বাস করত আজ থেকে প্রায় ২৮০-২২৫ মিলিয়ন বছর আগে। মধ্য পার্মিয়ান যুগ থেকে ট্রায়াসিক যুগের শুরু পর্যন্ত টিকে ছিল তারা। তখনকার সময়ের Cartilaginous fish বা তরুণাস্থিময় মাছের মধ্যে তারা ছিল বৃহদাকৃতির। গড়ে এরা ২৫-২৬ ফুট ছিল এবং ধারণা করা হয় তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মাছগুলো বর্তমান যুগের গ্রেট হোয়াইট শার্কের চেয়েও আকারে বড় ছিল।

এদের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বৈশিষ্ট্য নিঃসন্দেহে তাদের দাঁত। প্রাণীজগতের মধ্যে এমন ইউনিক স্ট্রাকচারের চোয়াল সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হলো এই করাত মুখে নিয়ে এরা ঘুরত কী করে? মুখ বন্ধ করতই বা কীভাবে? এজন্য আমাদের এদের মুখের স্কেলিটাল স্ট্রাকচারের দিকে তাকাতে হবে।
হেলিকোপ্রিয়নের মুখের উপরের অংশ Rostrum এ বসানো চোয়ালে ছিল ছোট ছোট দাঁত। সারি করে বিছানো দাঁতের পাটির মাঝে ছিল গর্ত, যেটাকে বলা হয় নচ। নিচের চোয়ালটাই এদের মূল বৈশিষ্ট্য। সাধারণ কোনো চোয়াল নয়, বরং অনেকগুলো দাঁতের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্পাইরাল ব্লেড। যখন তারা মুখ বন্ধ করত, স্পাইরাল ব্লেড উপরের নচের মধ্যে ঢুকে সেট হয়ে যেত। এমন গঠনের ফলেই মুখে আস্ত একটা করাত নিয়েও মাছটা দিব্যি সাঁতরে বেড়াত।

                 Tooth Whorl
তাদের চোয়ালকে বলা হয় Tooth whorl. যেটা আকারে গোল এবং রোলিং করার ক্ষমতা ছিল। অর্থাৎ স্পাইরাল ব্লেডটি অনেকটা রোল করে প্যাঁচানো দাঁতের সারি, যেটা সামনে বা পেছনে ঘোরানো যেত। চোয়ালের অনেকখানি অংশ মুখের অভ্যন্তরে থাকত এবং প্রয়োজনবোধে সেটা ঘুরিয়ে বাইরে আনতে পারত তারা। এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় Tooth whorl এর ব্যাস প্রায় ৪০ সে.মি। সামনের ও পেছনের দাঁতগুলো আকারে ছোট হত এবং মাঝখানের দাঁত লম্বা হতো। লম্বায় প্রায় ১০ সে.মি. পর্যন্ত দাঁতও পাওয়া গেছে।

হেলিকোপ্রিয়নের যত ফসিল স্পেসিমেন পাওয়া গেছে তার মধ্যে বেশিরভাগই দাঁতের ফসিল। শারিরীক গঠন সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। যতদূর জানা যায়, তাদের কঙ্কাল ছিল তরুণাস্থিময়। তাই এদের রাখা হয়েছে কনড্রিকথিস শ্রেণিতে। এদের শারিরীক গঠনকে বলা হয় Fusiform. যা স্পিন্ডলের মত দেখতে। দুটো ত্রিভুজাকৃতির Pectoral fin (বক্ষ-পাখনা) দিয়ে এরা সাঁতার কাটত।পৃষ্ঠদেশে ছিল বড় আকৃতির একটি Dorsal fin (পৃষ্ঠ-পাখনা), যা তাকে চলাচলের সময় ব্যালেন্স ধরে রাখতে সহায়তা করত। এবং পেছনে বিশাল কাঁটাযুক্ত লেজ, যেটায় সংযুক্ত ছিল Caudal fin বা পুচ্ছ-পাখনা। এই বিশাল লেজ তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করত। অন্যান্য তরুণাস্থিময় মাছের মতই ফুলকা দিয়ে শ্বাস নিত তারা। মাথার পাশে কয়েক জোড়া বড় বড় ফুলকা ছিল তাদের শ্বসন অঙ্গ।

প্রশ্ন আসতে পারে এই করাত আকৃতির দাঁত নিয়ে তারা খেত কী করে, খাবার চিবিয়ে নিতই বা কী করে? খাবারের পদ্ধতিটা বেশ ইন্টারেস্টিং। হেলিকোপ্রিয়নের খাবার ছিল প্রাগৈতিহাসিক সেফালোপডস- শামুক, স্কুইড ও অক্টোপাস জাতীয় জীব। তবে ধারণা করা হয় শেষদিকে তাদের খাবারের তালিকায় ভার্টিব্রেটস তথা মাঝারি সাইজের হাড়যুক্ত বা তরুণাস্থিময় মাছেরাও যুক্ত ছিল। এদের মুখে পড়া যেকোনো শিকারের প্রথম পরিণতি ছিল কেটে দুভাগ হওয়া।করাতের চাপে সেফালোপডদের খোলস ভেঙে চৌচির হত এবং শিকার দুভাগ হয়ে যেত। কাটা টুকরোগুলোকে তারা বারবার চিরতে থাকত এবং ছোট ছোট স্লাইসে ভাগ করে ফেলত। এরপর চোয়ালকে ঘুরিয়ে স্লাইসগুলোর উপর একটা পশ্চাৎমুখী বল প্রয়োগ করা হতো এবং খাবার অভ্যন্তরে চলে যেত।এভাবেই ভোজনপর্ব সারত তারা।

তাহলে,
আমদের এই করাতওয়ালা মন্সটারের লাইফ জার্নিটা কেমন ছিল?

অন্যান্য প্রি-হিস্টোরিক জীবের সাথে তুলনা করলে এরা খুব কম সময়ের জন্যই টিকে ছিল। কিন্তু এদের ব্যাপারে সবচেয়ে মজার তথ্য হলো এরা পার্মিয়ান-ট্রায়াসিক এক্সটিংকশন সার্ভাইভ করা অল্প কিছু প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম।
২৫ কোটি বছর আগে আগে ঘটা পার্মিয়ান-ট্রায়াসিক এক্সটিংকশন ইভেন্টকে বলা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক গণবিলুপ্তি। আগ্নেয়গিরির  ভয়াবহ অগ্নুৎপাতে স্ট্রাটোস্ফিয়ার পর্যন্ত ছাই ছড়িয়ে পড়েছিল। নেমে এসেছিল কেয়ামত। পৃথিবী ঢাকা পড়ে যায় কালো অন্ধকারে। কেউ কেউ অবশ্য এর পেছনে উল্কাপাত বা কাছাকাছি কোনো সুপারনোভার বিস্ফোরণকেও দায়ী করেন। কারণটা যাই হোক, ফলাফল ছিল ভয়াবহ। এই বিলুপ্তিতে সমুদ্রের প্রায় ৯৬% ও ডাঙার ৭০% প্রাণীই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পৃথিবী এত বিষাক্ত হয়ে পড়ে যে প্রায় ১ কোটি বছর লেগেছিল আগের অবস্থায় ফিরে আসতে।

মজার ব্যাপার হলো, কোনোভাবে করাতওয়ালা হেলিকোপ্রিয়ন এই  ভয়াবহ এক্সটিংকশনে টিকে যায়। কিন্তু এর পরেও তারা ট্রায়াসিকের বেশি সময় পার করতে পারেনি। সমুদ্রে তখন শুরু হয় ইকথাইওসরের রাজত্ব, ইকথাইওসররা ছিল ট্রায়াসিকের সমুদ্র দখল করে নেয়া মেরিন রেপটাইলস।
এরা যেকোনো খাবারই খেয়ে নিত, হেলিকোপ্রিয়নের প্রধান খাবার সেফালোপডদেরও।

                  Ichthyosaurs
প্রি-হিস্টোরিক যুগের রীতি ছিল হয় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকো, না হয় বিলুপ্ত হয়ে যাও। হেলিকোপ্রিয়নকেও এই পরিণতি বরণ করে নিতে হয়।প্রতিযোগিতায় হেরে তারা বিদায় নেয় সমুদ্রের বুক থেকে।
এভাবেই শেষ হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগের অন্যতম ইন্টারেস্টিং ও ইউনিক জীবের গল্প। এরা আজও প্যালাসিওন্টোলজিস্টদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। এখনও তাদের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানার বাকি আছে।

নিঃসন্দেহে প্রি-হিস্টোরিক যুগের জীবদের মধ্যে অনন্য স্থান দখল করে রাখবে হেলিকোপ্রিয়ন, যার মুখের ওই করাতের সম্মুখীন কখনোই হতে চাইবে না কেউই।



References-







Pbs Eons.

সায়েন্সভেঞ্চার- নাঈম হোসেন ফারুকী।

Post a Comment

Previous Post Next Post