রয়েল বেঙ্গল টাইগার
বাংলাদেশ।
শব্দটি শুনলেই যে কারো মনে ভেসে আসে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে থাকা ছোট এক খন্ড দেশ, যেখানে রয়েছে প্রকৃতির অপার লীলা। রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, সুন্দরবন। যে বনে আছে বাঘের গর্জন। বিশ্বে যা কিছুর জন্য পরিচিত এই দেশ, তার মধ্যে অন্যতম হলো সুন্দরবনের বাঘ। বল, ক্ষিপ্রতা ও শক্তিতে যার সমকক্ষ কেউ নেই।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ, আমাদের জাতীয় পশু। হারিয়ে যেতে বসেছে এদেশ থেকে। বিলুপ্তির পথে সুন্দরবনের রাজারা। এক সময় মধুপুর এবং গাজীপুরেও মিলত বাঘের দেখা। এখন শুধু সুন্দরবনে পাওয়া যায় বাঘ।
কয়েক দশকের ব্যবধানে সুন্দরবনেও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বাঘের সংখ্যা। Internaional Union for Conservation of Nature (IUCN) রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে EN(Endangered) ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বিপদগ্রস্ত প্রাণীতে পরিণত হয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। অথচ এই বাঘই আমাদের বাংলার গর্ব, বাংলার অনন্য জীবিবৈচিত্যের অন্যতম মুখ্য পরিচায়ক।
শ্রেণিবিন্যাস-
জগৎ : Animalia
পর্ব : Chordata
শ্রেণি: Mammalia
বর্গ : Carnivora
উপবর্গ : Feliformia
পরিবার : Felidae
উপপরিবার : Felidae
গণ : Panthera
প্রজাতি : P. tigris
উপপ্রজাতি : P. t. tigris
রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের কাছে সুপরিচিত একটি প্রাণী। এদের গঠন, বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশি জানি। বিশ্বে সাইবেরীয় বাঘের পরে বাঘের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপপ্রজাতি বেঙ্গল টাইগার। উপমহাদেশের অনেক জায়গাতেই দেখা মেলে তাদের। সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগারকে আদর করে ডাকা হয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার। রাজকীয় স্বভাব, রাজকীয় হালচাল। যারা রাজত্ব করে বেড়ায় লবণাক্ত বনভূমির মাটিতে।
ডোরাকাটা দাগের বেঙ্গল টাইগার মামাকে সহজেই চেনা যায়। এদের গায়ের রঙ হালকা হলুদ থেকে কমলা রঙের হয়, সারা গায়ে থাকে খয়েরি-কালো ডোরাকাটা দাগ। পেট সাদা এবং লেজে রয়েছে কালো আংটির মত গোল গোল দাগ। চোখে হিংস্র স্থির দৃষ্টি। মজার ব্যাপার হলো, প্রতিটি বাঘ তাদের ডোরায় অনন্য। দুটি বাঘের ডোরা একই হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। জেনেটিক বা অন্য কোনো কারণে কোনো বাঘের গায়ে ডোরা নাও থাকতে পারে। লেজসহ একটি পুরুষ বাঘের দৈর্ঘ্য ২১০-৩১০ সে.মি. এবং স্ত্রী বাঘের দৈর্ঘ্য ২৪০-২৬৫ সে.মি. হয়ে থাকে। স্ত্রী বাঘের চেয়ে পুরুষ বাঘ আকারে বড় হয়।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার পুরো বিশ্বের বাঘসনূহের মধ্যে হিংস্রতায় অনন্য। এদের দাঁতের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ সেন্টিমিটারের মত। এর সাথে রয়েছে ধারালো নখরযুক্ত থাবা। শিকারকে কামড়ে বা খামচে ধরলে সহজে পালাবার জো নেই। এরা বেশ ভোজনরসিক। মোষ, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বুনো শুকরসহ বড় আকারের প্রাণীরা তাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
সুন্দরবনের রাজাদের উপযুক্ত পরিচয় মেলে শিকারের সময়। তারা বেশ কৌশলী। ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকে এবং সুযোগ বুঝে খপ করে শিকার ধরে ফেলে। শক্তিশালী থাবার চাপে শিকারের হাড়গোড় পিস্ট করে দেয়, ঘাড়ে বসায় মরণ ঘাতী কামড়। সহজে পালাতে পারে না শিকার। সাধারণত একা একাই শিকার ধরে এবং একাই সাবাড় করে দেয়। শিকার ধরার পর টেনে ডেরায় নিয়ে গিয়ে আয়েশ করে সারে ভোজন পর্ব। এরা খুব ভালো সাতারু। অনেক সময় শিকারকে নিয়ে নদীও পাড়ি দেয় তারা।খাবারের অভাবে লোকালয়েও আক্রমণ করতে দেখা যায় তাদের।
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের স্বভাব-চরিত্র খুবই ভয়ানক। অন্য প্রাণীদের প্রতি একেবারেই বন্ধুত্বসুলভ আচরণ প্রদর্শন করে না তারা। একাকী থাকতে পছব্দ করে। গাছাগাছালি মুড়িয়ে নিজের এলাকা চিহ্নিত করে রাখে। অন্য বাঘেরা সেই চিহ্ন দেখে সাবধানে চলে। কারো সীমানা মাড়ালেই লেগে যায় তুমুল যুদ্ধ।
এক সময় একাকী বাঘের জীবনে সঙ্গী হয়ে আসে বাঘিনী। প্রজননকালে একসাথে থাকে তারা। বাঘিনী সাধারণত ১-৪ টি শাবকের জন্ম দেয়। ততদিনে পুরুষ বাঘ আবার আলাদা হয়ে যায়। জন্ম নেয়া শাবকের প্রায় অর্ধেকই কোনো না কোন কারণে মারা যায়। শাবকরা জন্ম নেয় অন্ধ হয়ে। ১০ দিনের মাথায় চোখ ফোটে তাদের। ছয় মাস পর্যন্ত দুগ্ধপান করার পর মায়ের কাছে শিকারী জীবনের হাতে-খড়ি ঘটে শাবকের। দু বছর পর্যন্ত মায়ের সাথে থাকে, এর মধ্যেই শিকার করা শিখে যায়। এরপর আবার শুরু হয় একাকী জীবন। এভাবেই চলতে থাকে বাঘের জীবনচক্র।
আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। অনেক ঐতিহ্যগত বস্তুর সাথে প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয় বাঘ। ক্রীড়া দলগুলোকেও ডাকা হয় বাঘের নামে।
বাঘ যেন সাহস আর উদ্যমের প্রতীক। বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী সম্পদ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দশকে বিপুল হারে কমে এসেছে বাঘের সংখ্যা। চোরা শিকারীদের দাপটে বাঘের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বাঘের চামড়া, দাঁত ইত্যাদি চড়া দামে বাজারে বিকি করা হয়। তাই শিকারীরা নিধন করছে বাঘ। বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণকেও নির্বিচারে শিকারীদের কবলে পড়তে হচ্ছে। ফলে দেখা দিচ্ছে খাদ্যাভাব এবং লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বাঘ। মানুষের হাতে মারা পড়ছে। গত শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশের ৯৭ শতাংশ বাঘ হারিয়ে গিয়েছে। বাকি বাঘগুলোও দ্রুতই হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আমাদের জাতীয় পশু, জাতির গৌরবের প্রতীককে এভাবে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। বাঘকে রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে সুন্দরবনের আসল সৌন্দর্য।
বাংলার সাহস আর উদ্যমের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জনে প্রকম্পিত হয়ে উঠুক সুন্দরবনের আকাশ-বাতাস। বেঁচে থাকুক সুন্দরবনের রাজারা।
References -
Tags:
জীববৈচিত্র্য