ছায়াপথের গল্প

ছায়াপথের গল্প

বিশাল এই মহাবিশ্বের পৃথিবী নামক এক ক্ষূদ্র গ্রহের বাসিন্দা আমরা। মাথার উপর তাকালে দেখতে পাই বিশাল মহাকাশ। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে থেকে এই অসীম মহাকাশের শুরু, দূরে তাকালে কোথাও তার কোনো সীমানা খুঁজে পাই না আমরা। বেশিরভাগ অংশই নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকা। এর মাঝে আছে ছোট ছোট কুপির মত জ্বলতে থাকা কিছু নক্ষত্র। যাদের ঘিরে ঘুরে চলেছে কিছু গ্রহ, উপগ্রহ, ধুমকেতু, গ্রহাণু। এই বিশাল বস্তুপুঞ্জের সমষ্টি নিয়ে গঠিত গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ।

ইংরেজি গ্যালাক্সি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ Galaxias থেকে। এর অর্থ রাস্তা বা পথ।
অর্থাৎ গ্যালাক্সি হলো নক্ষত্রের সমন্বয়ে তৈরি বিশাল আলোকিত রাস্তা।
মহাকাশের বিভিন্ন জায়গায় বিশাল দুরত্বব্যাপী মহাকাশীয় বস্তুসমূহ- গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধূলিকণা, আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ও প্রচুর পরিমাণ অদৃশ্য হাইপোথিটিক্যাল ডার্ক ম্যাটার তুলনামূলক কাছাকাছি অবস্থানে থেকে একটি সুশৃঙখল ব্যবস্থা গড়ে তোলে।যাকে আমরা বলি গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ।
আমরাও এমন একটি ছায়াপথেরই অংশ যা পরিচিত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ নামে।

ধারণা করা হয়, আজ হতে প্রায় ১৩.৬ বিলিয়ন বছর আগে গ্যালাক্সি তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল। বিগ ব্যাং এর ফলে সৃষ্ট শিশু মহাবিশ্ব প্রথমদিকে অনেক উত্তপ্ত ও অস্থিতিশীল ছিল। ক্রমে বস্তুপুঞ্জ শীতল হতে শুরু করে এবং একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষিত করতে শুরু করে। তৈরি হয় বিশাল মহাজাগতিক মেঘ ( Giant molecular Clouds) এবং আন্তঃনাক্ষত্রিক ধুণিক্ণার (Interstellar Dusts) ভান্ডার।
 
             Interstellar space
ক্লাউডগুলোর অভ্যন্তরে কিছু জায়গায় গ্যাসীয় বস্তুপুঞ্জের ঘনত্ব অত্যধিক বেশি। এদের আমরা চিনি নীহারিকা বা নেবুলা নামে। নীহারিকাগুলোই প্রথমে নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছিল। নক্ষত্রগুলো নিজেদের নিয়ে বিভিন্ন আকৃতিতে গঠন করে বিশাল পরিবার। এই পরিবারকে বলা হয় গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ। একটি গ্যালাক্সি কয়েক আলোকবর্ষ হতে প্রায় কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
                    
                      Nebula 
গ্যালাক্সির বেশিরভাগ নক্ষত্রের উৎপত্তি ঘটেছে নীহারিকা থেকে।
নীহারিকারা প্রতিনিয়ত তারার জন্ম দেয়। কিছু অঞ্চল যেখানে গ্যাসের ঘনত্ব তুলনামূলক বেশি, তা আপন মহাকর্ষের প্রভাবে সংকুচিত হতে থাকে। জন্ম হতে থাকে নতুন নতুন নক্ষত্রের।

নক্ষত্রগুলো নিজেদের নিয়ে গঠন করতে থাকে গ্যালাক্সি। অনেক গ্যালাক্সির কেন্দ্রর দিকে তারাগুলো অত্যধিক ঘনত্বে থাকে। তাদের সংঘর্ষে তৈরি হয় দৈত্যাকৃতি কৃষ্ণগহবর (Supermassive Black hole)। এরা একাধিক মাঝারি বা ছোট ব্ল্যাকহোলের সমন্বয়েও তৈরি হতে পারে। যেসব গ্যালাক্সিতে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হয়, সেসব গ্যালাক্সির তারাগুলো তাদের সৌরজগত নিয়ে ব্ল্যাকহোলকে ঘিরে পরিভ্রমণ শুরু করে।এভাবে একটি সুশৃঙখল নক্ষত্রব্যাবস্থা বা গ্যালাক্সি গঠিত হয়।

সমগ্র মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ বিলিয়ন বা তারও বেশি গ্যালাক্সি রয়েছে।এদের মধ্যে আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ভিন্নতা আছে। যার ভিত্তিতে গ্যালাক্সিগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গ্যালাক্সির শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। যাকে বলা হয় Hubble Sequence.

         The Hubble Sequence 
হাবল সিকুয়েন্সে গ্যালাক্সিগুলোকে আকৃতির উপর ভিত্তি করে প্রধান কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। এগুলো হলো - সর্পিলাকার (Spiral),  উপবৃত্তাকার (Elliptical), অনিয়তাকার (Irregular) ও মসূরাকার (Lenticular). 

সর্পিলাকার ছায়াপথ (Spiral Galaxies) -

সাধারণভাবে গ্যালাক্সি শব্দটা শুনলে আমাদের চোখে স্পাইরাল গ্যালাক্সির চিত্রই ফুটে উঠে। কারণ গ্যালাক্সির উদারহণ হিসেবে আমরা স্পাইরাল গ্যালাক্সির ছবি দেখেই বেশি অভ্যস্ত।
এই গ্যালাক্সিগুলোর আকার কুন্ডলী পাকানো সাপের মত। গ্যালাক্টিক সেন্টার হতে স্পাইরাল আকৃতির বাহুগুলো বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং চারিদিকে ঘূর্ণায়মান নক্ষত্রের (Rotating stars) একটি ডিস্ক থাকে। একে বলা হয় হ্যালো (Halo). স্পাইরাল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকে Star density (তারার সমাবশ) অনেক বেশি ত্থাকে। এ অংশকে বলা হয় বাল্গ (Bulge) বা স্ফীত অংশ। সর্পিলাকার বাহুগুলোকে (Spital arms) বাকি সব অংশের চাইতে তুলনামূলক উজ্জ্বল দেখায়। কারণ এখানে নতুন নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। আর্মগুলোতে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস ও ধূলিকণা থাকে। তাই স্পাইরাল আর্মগুলো প্রতিনিয়ত নতুন নক্ষত্র তৈরি করতে পারে।

                The milky way 
আমরা যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে বাস করছি এটিও একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সি। এর ব্যাস প্রায় ১,০৫,৭০০ আলোকবর্ষ। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে প্রায় ১০০-৪০০ বিলিয়ন তারা রয়েছে।গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল 'স্যাজিটেরিয়াস-এ*' (Sagittarius A*)  যার ব্যাস প্রায় ৪৪ মিলিয়ন কি.মি। কিছুদিন আগে বিজ্ঞানীরা রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে এই ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। 
        
                 Sagittarius A*
মিল্কিওয়ের প্রধান চারটি স্পাইরাল আর্ম হলো CygnusSagittarius,  
Scutum-Crux এবং Perseus আর্ম।
আমাদের সৌরজগত গ্যালাক্সির কেন্দ্র হতে ২৫,০০০ আলোকবর্ষ দুরে একটি ছোট স্পাইরাল আর্মে অবস্থিত। এর নাম Orion spur

          Arms of the Milky way
মিল্কিওয়ের প্রতিবেশী স্পাইরাল গ্যালাক্সি হলো অ্যান্ড্রোমিডা বা M31.  এটি অত্যন্ত বৃহৎ, প্রায় ২,২০,০০০ আলোকবর্ষ ব্যাসের এই গ্যালাক্সিতে  অন্তত ১০০ ট্রিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে।
আজ থেকে প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন বছর পর মিল্কিওয়ে ও অ্যান্ড্রোমিডা পরষ্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। তৈরি হবে মিল্কোমিডা নামের একটি উপবৃত্তাকার (Elliptical) গ্যালাক্সি।

উপবৃত্তাকার ছায়াপথ (Elliptical Galaxies) -

বেশিরভাগ ইলিপটিক্যাল গ্যালাক্সিই গঠিত হয়েছে দুটি স্পাইরাল গ্যালাক্সির সংঘর্ষের ফলে। তাই এদের আকৃতি বিশাল হয়। গ্যালাক্সিগুলোর আকৃতি হয় ডিম্বাকার বা ফুটবলের মত। বড় ইলিপটিক্যাল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। যাকে ঘিরে নক্ষত্রসমূহ পরিভ্রমণ করতে থাকে। উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সির কোনো বাহু থাকে না। বরং নক্ষত্রগুলো মিলে উপবৃত্তাকার বাল্গ বা স্ফীত অংশ তৈরি করে। এসব গ্যালাক্সির বেশিরভাগ নক্ষত্রই পুরনো হয়। যার ফলে তাদের নিস্প্রভ দেখায়। অর্থাৎ স্পাইরাল গ্যালাক্সির চেয়ে এদের উজ্জ্বলতা কম হয়ে থাকে। 

                      IC1101
গ্যালাক্সিগুলোতে ইন্টারস্টেলার ম্যাটার (গ্যাস,ধূলিকণা) খুব কম থাকে বলে নতুন নক্ষত্র তেমনভাবে তৈরি হয় না। তাই তারাগুলো পুরোনো হতে থাকে এবং গ্যালাক্সির উজ্জ্বলতা কমে যায়।মহাবিশ্বের বড় বড় গ্যালাক্সিগুলোর বেশিরভাগই উপবৃত্তাকার।এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সি IC 1101 একটি সুপারজায়ান্ট ইলিপটিক্যাল গ্যালাক্সি, যার ব্যাস প্রায় ৩১,৯১,৩৯০ আলোকবর্ষ।

অনিয়তাকার ছায়াপথ (Irregular Galaxies) -

যেসব গ্যালাক্সি হাবল সিকুয়েন্সে পড়ে না তাদের বলা হয় ইরেগুলার গ্যালাক্সি বা অনিয়তাকার ছায়াপথ। এসব গ্যালাক্সি অ্যাসিমেট্রিক। তাদের নির্দিষ্ট কোনো আকৃতি নেই। নক্ষত্রগুলো বিশৃঙখল ভাবে থাকে, কোনো Bulge  (স্ফীত অংশ) বা Arm (বাহু) গঠন করে না। ধারণা করা হয়, স্পাইরাল বা ইলিপটিক্যাল গ্যালাক্সির কিছু অংশ মহাকর্ষের প্রভাবে বেরিয়ে গিয়ে এই ধরনের গ্যালাক্সি গঠন করে। এজন্য বেশিরভাগ ইরেগুলার গ্যালাক্সিই বামন বা অনেক ছোট গ্যালাক্সি।

             Canis Major dwarf 
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী Canis major dwarf galaxy একটি বামন অনিয়তাকার গ্যালাক্সি। যেটি মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে ৪২,০০০ আলোকবর্ষ এবং সূর্য থেকে মাত্র ২৫,০০০ আলোকবর্ষ দুরে অবস্থিত। এর ব্যাস মাত্র ২৫-২৬ আলোকবর্ষ।

মসূরাকার ছায়াপথ (Lenticular Galaxies) -

অনেক সময় এই ছায়াপথগুলোকে অনিয়তাকার শ্রেণিতেই রাখা হয়। তবে সাম্প্রতিককালে এদের আলাদা একটি শ্রেণি হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। লেন্টিকুলার গ্যালাক্সি  স্পাইরাল ও ইলিপটিক্যাল এর মাঝামাঝি আকৃতির গ্যালাক্সি।
এর কেন্দ্রে স্পাইরালের মত স্ফীত অংশ থাকে, কিন্তু কোনো বাহু থাকে না৷ আবার এরা ইলিপটিক্যাল এর মত অর্ধবৃত্তাকারও নয়। অনেকটা লেন্স আকৃতির ডিস্কের মত দেখতে। তাই তাদের ডিস্ক গ্যালাক্সিও বলা হয়। ধারণা করা হয়, এরা স্পাইরাল থেকে কোনো গ্যালাক্সির আকর্ষণে তাদের বাহুগুলো হারিয়ে এই আকৃতি পেয়েছে।

                   NGC 5866
চ্যাপ্টা ডিস্কগুলোতে অধিক পুরোনো নক্ষত্রগুলো থাকে এবং ইলিপটিক্যাল গ্যালাক্সির মতই কম ইন্টারস্টেলার ম্যাটার থাকায় নতুন নতুন নক্ষত্র তৈরি করতে পারে না। ফলে এরাও কম উজ্জ্বল হয়। আকৃতিতে সাধারণ স্পাইরালের চেয়ে তুলনামূলক ছোট হয় এরা। NGC 5866 একটি সুপরিচিত লেন্টিকুলার গ্যালাক্সি, যার ব্যাস মাত্র ৬০,০০০ আলোকবর্ষ।

এই হলো ছায়াপথের কেচ্ছাকথন।

গ্যলাক্সিদের জীবন থেমে নেই।
তারা একসাথে সমাবেশ সৃষ্টি করে।
অনেকগুলো গ্যালাক্সি মিলে তৈরি হয় গ্যালাক্সি ক্লাস্টার। আমাদের মিল্কিওয়েও Virgo সুপারক্লাস্টারের একটি লোকাল গ্রুপের অন্তর্গত স্পাইরাল গ্যালাক্সি।
গ্যালাক্সিরা স্থির থাকে না। একে অপরকে আকর্ষণ করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তাদের মিলনে তৈরি হয়  নতুন নতুন বিশালাকারগ্যালাক্সি। আবার কোনো কোনো গ্যালাক্সি নিজের চেয়ে ছোট গ্যালাক্সিকে তার দিকে টেনে নেয়। কেউ বা অন্য গ্যালাক্সি থেকে ছিনিয়ে নেয় কিছু অংশ।
এভাবেই চলতে থাকে ছায়াপথের খেলা।

রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে গ্যালাক্সিদের সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হই। উপলদ্ধি করি মহাবিশ্বের বিশালতা।
এখনও পর্যন্ত অসংখ্য গ্যালাক্সি আবিষ্কৃত হয়েছে, যত জেনেছি ততই অবাক হয়েছি। কত বিশাল এই মহাবিশ্ব! অথচ এখনও অনেক গ্যালাক্সি আবিষ্কৃত হওয়া বাকি আছে, প্রতিনিয়ত হচ্ছে। আমরা যতই মহাবিশ্বকে জানব, ততই আমাদের ক্ষূদ্রতা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সমগ্র মহাবিশ্বের তুলনায় গ্যালাক্সি একটি ক্ষুদ্র উপাদান, আমাদেরকে নিজেদের ক্ষূদ্রতার সীমা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।


References-




Post a Comment

Previous Post Next Post