ডার্ক ওয়েব
আজকাল আমরা যে শব্দগুলো সবচেয়ে বেশি শুনে থাকি, তার মধ্যে অন্যতম হলো "ডার্ক ওয়েব"। ডার্ক ওয়েবকে কেন্দ্র করে আমাদের মনে রয়েছে অসংখ্য জল্পনা-কল্পনা। কেউ কেউ মনে করেন ডার্ক ওয়েব মানেই এমন এক অন্ধকার দুনিয়া, যেখানে অপরাধ ছাড়া আর কিছুর দেখা মেলে না। আসলেই কি তাই? প্রকৃতপক্ষে আমরা অনেকেই এই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা রাখি না। এই ব্যাপারে রটানো বিভিন্ন গুজব ও কন্সপিরেসিগুলো বিশ্বাস করে নেই এবং ভয় পাই। তাই এই বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা থাকা জরুরি।
ডার্ক ওয়েব সম্পর্কে ধারণা রাখতে হলে প্রথমে জানতে হবে বিভিন্ন প্রকার ওয়েব সম্পর্কে। ইংরেজি " web" শব্দটির অর্থ হলো জাল। সহজ ভাষায় ইন্টারনেটে জালের ন্যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ওয়েবসাইটের বিস্তৃত নেটওয়ার্ককে বলা হয় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, বা সংক্ষেপে ওয়েব। ওয়েবসাইট হলো ওয়েবের নির্দিষ্ট অংশ, যেখানে আমরা আমাদের প্রয়োজনমত কন্টেন্ট ও সেবা পেয়ে থাকি। বিভিন্ন প্রকার ওয়েব রয়েছে।
ওয়েবের প্রকারভেদ-
যদি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ওয়েব নেটওয়ার্ককে একটি সমুদ্রের সাথে তুলনা করা হয়, তবে এর তিনটি স্তর পাওয়া যায়। সমুদ্রের উপরিভাগকে বলা হয় সার্ফেস। সেটা আমরা সবাই দেখতে পারি এবং যেখানে অবাধে যেকোনো নৌযান চলাচল করতে পারে। তেমনিভাবে ওয়েব নেটওয়ার্কের সবচেয়ে উন্মুক্ত অংশকে বলা হয় সার্ফেস ওয়েব। সমুদ্রের গভীরতা যত বাড়তে থাকে, সেখানে পৌছানো ততটা কঠিন হয়ে যায়। সবশেষে সমুদ্রের তলার দিকে থাকে ঘোর অন্ধকার। ঠিক তেমনভাবে ওয়েবের গোপন অংশটি ও ডিপ ও ডার্ক ওয়েবে বিভক্ত। সেগুলো সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়।
সার্ফেস ওয়েব-
আমরা সবাই প্রতিনিয়ত যেসব সাইট ব্যবহার করি সেগুলো সার্ফেস ওয়েবের অন্তর্গত। এখানকার সাইটগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত, যে কেউ ভিজিট করতে পারে সহজে। ফেসবুক, ইউটিউব, বিভিন্ন কমার্শিয়াল বা সেবামূলক সাইট যেগুলো আমরা ব্যবহার করি তার সবই এই ওয়েবের অংশ। কাজেই এটি নিয়ে আর বেশি কিছু আলোচনা করার নেই।
ডিপ ওয়েব-
এখান থেকে শুরু হবে ইন্টারনেটের গোপন জগতের জার্নি। যেসব ওয়েবসাইট কোনো সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ করে খুঁজে পাওয়া যায় না, সেগুলো ডিপ ওয়েবের অংশ। এই সাইটগুলোকে বলা হয় নন-ইনডেক্সড সাইট। অর্থাৎ সাইটগুলো গুগল বা অন্য সার্চ ইঞ্জিনে ইনডেক্স করা থাকে না। সার্চ ইঞ্জিন ইনডেক্সিং হুলো এমন একটা প্রসেস যার মাধ্যমে একটি সার্চ ইঞ্জিন তার সমস্ত ওয়েবসাইটগুলোর তথ্যগুলোকে সংরক্ষণ করে সাজিয়ে রাখে। যখন কোনো কিছু সার্চ দেওয়া হয়, তখন সার্চ সম্পর্কিত অসংখ্য সাইট থেকে কোনগুলো হোমপেইজে আসবে তা নির্ধারিত হয় এই ইনডেক্স দ্বারা। ডিপ ওয়েবের সাইটগুলো এই ইনডেক্সের অংশ না হওয়ায় এগুলোকে খুঁজে পেতে বিশেষ ইউআরএল ব্যবহার করতে হয়। একমাত্র এর মাধ্যমেই সাইটগুলোকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বিভিন্ন একাডেমিক জার্নাল, সিক্রেট লাইব্রেরি, এমনকি ব্যাংকও তাদের ওয়েবসাইটে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে।
ডার্ক ওয়েব-
ইন্টারনেটের সবচেয়ে গভীর ও অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশ হলো ডার্ক ওয়েব। এই ওয়েবের সাইটগুলো সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজে পাওয়া তো দূর, এগুলোকে এক্সেস করতে আলাদা ব্রাউজার ব্যবহার করতে হয়৷ সবচেয়ে জনপ্রিয় ডার্ক নেটওয়ার্ক হলো Tor. এছাড়া Freenet, I2P, IPFS ইত্যাদিও উল্লেখযোগ্য।
অনেকেই ডিপ ওয়েব এবং ডার্ক ওয়েবকে একই ধরনের নেটওয়ার্ক মনে করেন। বাস্তবে বিষয়টি একেবারেই তেমন নয়। ডিপ ওয়েবের সাইটগুলোর সঠিক ইউআরএল জানা থাকলে সাধারণ ব্রাউজারের মাধ্যমেই সেগুলোতে প্রবেশ করা যায়। কিন্তু আলাদা ব্রাউজার এবং প্রক্সি ছাডা ডার্ক ওয়েবে ঢোকা যায় না। তাই ডার্ক ওয়েব নিয়ে মানুষের মধ্যে এক অদম্য কৌতূহল কাজ করে। ইন্টারনেটে ডার্ক ওয়েব নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে অনেক তথ্যই সত্য, আবার অনেক কিছুই মিথ্যা।
ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করা কি আসলেই খুব কঠিন?
ডার্ক ওয়েব নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাগুলোর একটি হলো- এখানে প্রবেশ করা প্রায় দুঃসাধ্য। কথাটা একেবারেই সত্য নয়। বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে যে কেউ ডার্ক নেটওয়ার্কে ঢুকতে পারে। যেমন কেউ তার ডিভাইসে Tor project ডাউনলোড করে Onion Routing এ কানেক্ট হওয়ার মাধ্যমে সহজেই ডার্ক ওয়েবে ঢুকতে পারে। ডার্ক নেটওয়ার্কের সাইটগুলোর ইউআরএল সার্ফেস ওয়েবের সাইটগুলো থেকে আলাদা। যেমন Tor নেটওয়ার্কে ফেসবুকে প্রবেশের জন্য আপনাকে ব্রাউজারের অ্যাড্রেসবারে facebookcorewwi.onion লিখে এন্টার চাপতে হবে৷ ডার্ক ওয়েবের সাইটগুলোর লিংক পেতে কিংবা সার্চ করতে কিছু সাইট এবং সার্চ ইঞ্জিন রয়েছে৷ যেমন The hidden wiki, Torch, Duckduckgo ইত্যাদি। The hidden Wiki তে আপনি অসংখ্য ডার্ক ওয়েব সাইটের লিংক পেয়ে যাবেন। Torch ও Duckduckgo হলো দুটি পরিচিত প্রাইভেট সার্চ ইঞ্জিন। এভাবে ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করার অসংখ্য উপায় রয়েছে।
ডার্ক ওয়েবে মূলত কী কী হয়?
ডার্ক ওয়েব একটি অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ জায়গা। এখানে আপনার প্রয়োজনমাফিক যেকোনো ধরনের কাজের সাইটই খুঁজে পাবেন। সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে থাকায় অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয় বেশি। তাছাড়া ডার্ক ওয়েব ব্রাউজ করার সময় ইউজারকে ট্রেস করা হয় না। তাই যে কেউ স্বচ্ছন্দে ব্রাউজ করতে পারে। এর সবচেয়ে বেশি সুবিধা নেয় অপরাধীরা। ডার্ক ওয়েবে তাই বেআইনি কাজই বেশি সংঘটিত হয়। মাদকদ্রব্যের ব্যবসা, অবৈধ অস্ত্র বিক্রির মতো অনেক আইনবিরুদ্ধ ব্যবসা গড়ে উঠেছে এখানে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সেন্সিটিভ কন্টেন্ট খুঁজে পাওয়া যায় ডার্ক ওয়েবে। কাউকে টর্চার করার দৃশ্য, চাইল্ড পর্নোগ্রাফির মতো ভয়ানক কাজের ভিডিও অবাধে রিলিজ হয় বিভিন্ন সাইটে। এমন অনেক সাইট রয়েছে যেখানে অসংখ্য মানুষ এই ধরনের কন্টেন্ট শেয়ার করে থাকেন। এবং ভিজিটররা সেগুলো দেখতে পারে, কমেন্টও করতে পারে। ডার্ক ওয়েব থেকে এই ধরনের কিছু ভয়ঙ্কর ভিডিও আমরা মাঝে মাঝে সার্ফেস ওয়েবে চলে আসতে দেখি। যদিও এটা খুব কমই দেখা যায়। তবে এ থেকেই ধারণা করা যায় ডার্ক ওয়েবে ঠিক কী কী খুঁজে পেতে পারেন আপনি। যাবতীয় অফেন্সিভ কন্টেন্টের স্বর্গ বলা চলে ডার্ক ওয়েবকে।
ডার্ক ওয়েব ব্রাউজিং ও সাইবার সিকিউরিটি -
ডার্ক ওয়েব ব্রাউজ করার সময় ইউজাররা অ্যানোনিমাস থাকেন এটা সত্য, তবে ভুল করে বসলে আপনি বিপদে পড়তে পারেন। ব্রাউজিং এর সময় কোনো সাইটে রেজিস্ট্রেশন করার প্রয়োজন হলে নিজের আসল ডিটেইলস না দেওয়াই উত্তম। এক্ষেত্রে বিকল্প ইমেইল এড্রেস ও পরিচয় ব্যবহার করতে পারেন আপনি। এছাড়া ভুলেও ডার্ক ওয়েব থেকে কোনো ফাইল ডাউনলোড করা উচিত নয়। এখানে থাকা ফাইলগুলোতে ম্যালওয়ার থাকতে পারে যেগুলো আপনার ডিভাইসকে আক্রমণ করে সম্পূর্ণ বিকল করতে সক্ষম। কিংবা ট্রোজানের মাধ্যমে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যও হাতিয়ে নেওয়া হতে পারে।
ডার্ক ওয়েবে অবৈধ কর্মকান্ড চালানোর দায়ে বিভিন্ন দেশের ব্যবহারকারীদের গ্রেফতার হওয়ার খবরও আমরা শুনে থাকি। তাই এমন কোনো সাইট ভিজিট না করাই উত্তম। এছাড়া এখানে অসংখ্য অ্যানোনিমাস চ্যাটিং সাইট রয়েছে যেগুলোতে আপনি কারো ফাঁদে পড়ে যেতে পারেন। তাই এখানকার কাউকে বিশ্বাস না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ডার্ক ওয়েব নিয়ে প্রচলিত কিছু গুজব-
ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করা বেআইনি-
ডার্ক ওয়েব নিয়ে প্রচলিত গুজবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যা শোনা যায় তা হুলো, এখানে প্রবেশ করাই বেআইনি। ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করা বেআইনি নয়। এখানে যেমন প্রচুর অপরাধমূলক কাজ ঘটে তেমনই ভালো উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা যায়। যেমন গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে কোনো সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য অ্যানোনিমাস কমিউনিটি তৈরি করা যায়।
ডার্ক ওয়েবে ঢুকলেই আপনার কম্পিউটার হ্যাক হয়ে যাবে-
এটিও ডার্ক ওয়েব নিয়ে বহুল প্রচলিত একটি গুজব। ডার্ক ওয়েবে ঢোকামাত্রই কম্পিউটার হ্যাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি কোনো সাইটকে সন্দেহজনক এক্সেস দেন কিংবা কোনো ফাইল ডাউনলোড করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি নিরাপদ থাকবেন।
রেড রুম-
ডার্ক ওয়েব নিয়ে কোনো ইউটিউব ভিডিও দেখে থাকলে আপনি এই শব্দগুলো অবশ্যই শুনে থাকবেন। এমন এক দল সন্ত্রাসী, যারা লাইভে এসে খুন করে। বাস্তবে এমন কোনো কমিউনিটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ডার্ক ওয়েবে বিভিন্ন সিক্রেট ক্রিমিনাল নেটওয়ার্ক থাকতে পারে এটা সত্য। তবে লাইভ স্ট্রিমিংয়ে খুন করার মতো কোনো কমিউনিটির অস্তিত্ব নেই।
এটি শুধুনাত্র ক্রিমিনালদের জন্য-
ডার্ক ওয়েব নিয়ে এই গুজবটিও অনেক জনপ্রিয়। তবে আপনি কি জানেন, ফেসবুকেরও অফিশিয়াল অনিয়ন সাইট রয়েছে? অর্থাৎ এখানে শুধু বেআইনি কাজ সংঘটিত হয় এমন নয়। শুধুমাত্র পরিচয় গোপন করে সার্ফেস ওয়েবের কোনো সাইট ব্রাউজ করার জন্যও আপনি তাদের ডার্কসাইট ব্যবহার করতে পারেন।
সুতরাং, যদি কৌতূহলবশত ডার্ক ওয়েব ভিজিট করতে যান, তাহলে তেমন কোনো ক্ষতি নেই। তবে নিজের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া কোনো অন্যায় কাজে জড়িত না হলে ইন্টারনেটের অন্ধকার দুনিয়ায়ও আপনি নিরাপদ থাকবেন।