Annabelle
ANNABELLE (2014) মুভির ভয়ানক চেহারার পুতুলটিকে চেনে না, এমন মানুষ আজকের যুগে খুব কমই আছে বোধহয়। যে পুতুলের উপর ভর করে দুষ্টু আত্মা, ঘটায় নানা ধরনের ভৌতিক কান্ড। এখনও রাতে অনেক মা-রাই তাদের বাচ্চাকে এই পুতুলের গল্প শুনিয়ে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ান।
এই পুতুল কিন্তু বাস্তবেই আছে। এটাও দাবি করা হয় মুভিগুলোর কাহিনী পুতুলটির সত্যিকারের কান্ডকারখানার আলোকেই রচিত। আসলেই কি তাই? পুতুলের উপর আদৌ ভূত ভর করে? বাস্তবে কি এমন কিছু ঘটেছিল?
ভৌতিক পুতুলের অরিজিনের দিকে তাকানো যাক। সিনেমায় দেখানো হয়েছিল একজন স্বামী তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে পুতুলটি উপহার দেন। সেই পুতুল তাদের বাসায় রাখার পর থেকে তারা বিভিন্ন সময়ে মুখোমুখি হন প্যারানরমাল ঘটনার। ঘটতে থাকে নানান দুর্ঘটনা। এই পুতুলকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে পুরো সিনেমা।
এই সিনেমার কাহিনী ধার করা হয়েছে এক্সরসিজম স্পেশালিস্ট অ্যাড এবং লরেন ওয়ারেনের কাছ থেকে। তারা বাস্তব অ্যানাবেলের যেসব বর্ণনা দেন তার ভিত্তিতেই তৈরি করা হয়েছে মুভি।
সত্যিকারের অ্যানাবেল ছিল জন্মদিনে মেয়ের প্রতি একজন মায়ের উপহার। ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাট প্রদেশের একজন মা তার নার্সিং পড়ুয়া মেয়েকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে এই পুতুলটা দেন। দাবি করা হয় এরপর থেকে পুতুলটিকে ঘিরে তার সাথে নানা ভৌতিক ঘটনা ঘটতে থাকে।
যে মেয়েটি পুতুল উপহার পেয়েছিল তার নাম ছিল ডোনা। সে তার বান্ধবী অ্যাঞ্জির সাথে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতো। জন্মদিনে ডোনা মায়ের কাছ থেকে পুতুল উপহার পায়। পুতুলের নাম কিন্তু শুরুতে অ্যানাবেল ছিল না। পুতুল আনার পর থেকেই তাদের বাড়িতে অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটতে থাকে। পুতুলটিকে তারা যেখানে রেখে বাইরে যেত, ফিরে এসে একই জায়গায় আর খুঁজে পেত না। আনার পর থেকেই তারা বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়। পুতুলটির সরাসরি নিজেই ভৌতিক আচরণ করার কথাও বলা হয়। পুতুলের মুখে রক্ত দেখা,কাগজে মেসেজ পাওয়াসহ এমন অনেক ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে। পরবর্তীতে তারা জানতে পারে যে অ্যাপার্টমেন্টে তারা থাকতো সেখানে আগে ছিল একটি বড় মাঠ। সেই মাঠে অ্যানাবেল হিগেন নামে সাত বছরের এক বাচ্চাকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই মেয়েটির আত্মাই এই পুতুলের উপর ভর করে। অ্যানাবেল তার মৃত্যুর কাহিনী ডোনা ও অ্যাঞ্জিকে খুলে বলে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে তাদের কোনো ক্ষতি করবে না। ডোনার মায়া হয় এবং সে অ্যানাবেলকে থাকতে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের সাথে ঘটতে থাকে বিভিন্ন দুর্ঘটনা এবং প্যারানরমাল কান্ড।
এ সমস্ত ঘটনার কথা উঠে এসেছে প্যারানরমাল স্পেশালিস্ট অ্যাড এবং লরেন ওয়ারেনের বর্ণনা অনুযায়ী। তাদের ভাষ্যমতে, পুতুলকে ঘিরে এসব ঘটনা ঘটতে থাকার পর ডোনা আর অ্যাঞ্জি তাদের কাছে পুতুলটা নিয়ে আসে। তখন তারা পুতুলটিকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং পরে তাদের মিউজিয়ামে রেখে দেন।
পুতুলের ভৌতিক আচরণ সম্পর্কে যেসব দাবি তারা করেছেন, আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে সেগুলোকে নেহাতই বানানো গল্প মনে হয়। তবে আজকের দিনেও কিছু মানুষ এসব বিশ্বাস করে। এছাড়া সেই গল্পের ভিত্তিতেই সিনেমা তৈরি হয়েছে (অবশ্যই আরো বেশি মশলাপাতি যোগ করে), আর সেই স্টোরিকে তারা সত্য দাবি করেছেন। অর্থাৎ মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি তাদের মতে বাস্তব ঘটনা।
তাই পুতুলের উপর আসলেই আত্মা ভর করতে পারে কিনা, তার বৈজ্ঞানিক ব্যবচ্ছেদ করা জরুরি।
অ্যানাবেল পুতুলের বাস্তবতা, ভৌতিক আচরণের সত্যতা ও মুভির সাথে এর বাস্তবের কাহিনীর কতটুকু মিল, এবং সেগুলো কতটুকু যৌক্তিক তা কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে একে একে বিশ্লেষণ করা যাক।
বাস্তবে পুতুলের চেহারা কি আসলেই ভূতুড়ে ছিল?
অ্যানাবেল মুভিতে যে পুতুলটা দেখানো হয়েছে সেটা দেখতে ভয়ানক। দেখেই গা ছমছম করে উঠবে যে কারো। অজান্তেই এই পুতুলকে ঘিরে অশুভ কল্পনা জেগে উঠতে পারে কারো মনে। কিন্তু বাস্তবে উপহার দেওয়া পুতুলটার চেহারা ছিল নিতান্তই নিরীহ। কোনদিক থেকেই পুতুলটাকে দেখে ভৌতিক চিন্তা জেগে উঠবে না আপনার মনে। অন্য দশটা সাধারণ পুতুলের মতোই দেখতে অ্যানাবেল। কানেক্টিকাটের একটা মিউজিয়ামে পুতুলটা রাখা আছে। ২০২০ সালে পুতুল হারিয়ে যাওয়ার একটা গুজব উঠেছিল, কিন্তু পরে সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
কোনো পুতুল কি নিজে নিজেই এক রুম থেকে অন্য রুমে যেতে পারে?
মুভিতে দেখানো দৃশ্য এবং বাস্তবে প্যারানরমাল রিসার্চারদের বর্ণনানুযায়ী, পুতুলটাকে রেখে যখন অ্যাঞ্জি ও ডোনা কোথাও যেত, ফিরে এসে তাকে আর আগের অবস্থায় পাওয়া যেতো না। পুতুলটিকে তারা আলাদা কোনো জায়গায়, অদ্ভূত রকম পজিশনে দেখতে পেতো। যেমন পা ক্রস করে বসে থাকা, নিলডাউন করে থাকা ইত্যাদি। পরে পুতুলটিকে হাতে ধরে এমন পজিশনে বসানো বা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেও পারা যায়নি। কারণ পুতুলটি এমনভাবে তৈরি করা ছিল যে তার শরীরকে এমন পজিশনে আনাই অসম্ভব। এর মাধ্যমেই পুতুলের গল্পের সত্য-মিথ্যা অনেকটা আন্দাজ করা যায়।
পুতুলের পক্ষে কাগজে মেসেজ লেখা কি সম্ভব?
মুভির স্টোরিলাইন এবং অ্যাড ও ওয়ারেনের বাস্তব দাবি করা স্টোরি- দুটো বর্ণনাতেই বলা হয়েছে পুতুলের পক্ষ থেকে তার মালিকরা বিভিন্ন মেসেজ পেতো। মুভিতে দেখানো হয়েছে পুতুলের মালিক দম্পতি ছোট ছোট কাগজে লেখা কিছু মেসেজ পেতেন যেগুলো পুতুলের উপর ভর করা অশরীরী আত্মা লিখত। "Help us"," Save us" - এই ধরনের কিছু মেসেজ দেখানো হয়েছে।
সত্যিকারের অ্যানাবেলের মালিক ডোনা এবং প্যারানরমাল রিসার্চারদের মতে তারাও বাস্তব অ্যানাবেলের কাছ থেকে এমন কিছু মেসেজ পেয়েছে। তবে সেগুলোর পক্ষে তারা কোনো যুক্তিযুক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। ভিডিও ফুটেজ কিংবা পুতুলের লেখার কোনো ছবি তারা দেখাতে পারেননি। কাজেই তাদের এই দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
পুতুলের উপর রক্ত কীভাবে আসে?
পুতুলের মালিকের ভাষ্যমতে পুতুলের উপর বিভিন্ন সময়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখা যেত। মুভিতেও এই দৃশ্য দেখানো হয়েছে। তাদের কথা অনুযায়ী, অনেকবারই তারা অ্যানাবেলের মুখের উপর কিংবা শরীরের অন্যান্য অংশে রক্ত দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু বাকি সব দাবির মতো তারা কেউই এমন কোনো ছবি বা ভিডিও ফুটেজ দেখাতে পারেননি।
পুতুলটি ঠিক কী কী ক্ষতি করেছিল?
ডোনার রুমমেট অ্যাঞ্জির হবু বর ল্যু কয়েকবার অ্যানাবেলের আক্রমণের শিকার হয়েছিল- এমনটা বলা হয়েছে। একদিন সে রাতে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায় এবং সে দেখতে পায় অ্যানাবেল তার পায়ের কাছে বসে আছে। পুতুলটা আস্তে আস্তে তার গায়ের উপর উঠে আসে এবং শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরদিন সকালে তার ঘুম ভাঙে। এসব ঘটনার পর তারা পুতুলটিকে ফেলে দিতে চেষ্টা করে কিন্তু পুতুলটা আবার তাদের বাসায় ফিরে আসে।
অন্য একটা অংশে বলা হয়েছে ল্যু আরেকদিন তাদের বাসায় ডোনার রুমের দরজা খুলে অ্যানাবেলকে কোণায় পড়ে থাকতে দেখে। সে পুতুলের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ তার মনে হয় পেছনে কেউ আছে, কিন্তু সে কাউকে দেখতে পায় না৷ পরক্ষণে সে নিজের বুকে আঁচড় দেখতে পায়, আঁচড়গুলো থেকে রক্ত বের হচ্ছিল।
মূলত এর পরেই তারা অ্যাড এবং ওয়ারেনের কাছে পুতুলটা নিয়ে যায়। এই দাবির পক্ষেও তারা কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।
এগুলো ছিল অ্যানাবেল মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি- যেটাকে সত্যি বলা হয় তার দাবিগুলোর খন্ডন। এছাড়া অ্যাড ও লরেন ওয়ারেন বিভিন্ন সময়ে অ্যানাবেলকে নিয়ে আলাদা আলাদা তথ্য উল্লেখ করেছেন। তাদের অনেক বর্ণনাই একটি অন্যাটির সাথে মেলে না। যেমন এক বর্ণনায় তারা অ্যানাবেল হিগেনকে সাত বছরের বাচ্চা দাবি করেছেন, অন্য আরেক বইয়ে লিখেছেন তার বয়স ছিল ছয়। তাদের বর্ণিত গল্পের এসব কন্ট্র্যাডিকশন অনেকাংশে গল্পের অসারতা বুঝিয়ে দেয়।
এছাড়া পুরো গল্পের বেশিরভাগ অংশই অনেক দিক থেকে খাপছাড়া। যেখানে অ্যানাবেলকে ফেলে দেওয়ার পরেও সে ফিরে আসে, এক রুম থেকে অন্য রুমে যেতে পারে, সেখানে এই পুতুল আজও সেই মিউজিয়াম থেকে পালাতে পারেনি। আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় হলো এত কাহিনী ঘটে যাওয়ার পরেও ডোনা এবং অ্যাঞ্জি তাদের থাকার ঘর পাল্টায়নি। তারা দিনের পর দিন সেই ভূতুড়ে পুতুলের সাথেই থেকেছে।
তাদের ভাষ্যমতে পুতুলটা প্রথমে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলেও পরে তার শয়তানি ভাব প্রকাশ পায়।
তাই বিজ্ঞানমহলে এই পুতুলের গল্প তথাকথিত রিসার্চার অ্যাড এবং লরেন ওয়ারেনের বানানো কন্সপিরেসি হিসেবে পরিচিত। অনেকের মতে এই গল্পগুলো অ্যানাবেলকে যে জাদুঘরে রাখা হয়েছে সেটার পরিচিতি বাড়ানোর জন্য বানানো। জাদুঘরের প্রচারণার জন্য সেখানে পুতুল রেখে পুতুল নিয়ে ভৌতিক গল্প রটানো হয়েছে। অ্যানাবেল মুভি এবং মিডিয়ায় কন্সপিরেসি থিওরিস্টদের মাখানো রঙে সেই কাহিনী আরো নাটকীয়তা পেয়েছে৷ তাই আজও অ্যানাবেল অনেকের কাছেই জনপ্রিয় একটা কন্সপিরেসি।
বিজ্ঞানমনস্ক ও লজিক্যাল মানুষের কাছে এই কাহিনীর সত্যতা ০%. এমন হরর গল্প পড়ে মজা ও থ্রিল পাওয়া যায় ভালো, তবে সেগুলো সত্যি ঘটনার উপর নির্মিত- এই কথা বিশ্বাস করাটা নিতান্তই কারো মূর্খামির পরিচয় তুলে ধরে।
References-
https://www.historyvshollywood.com/reelfaces/annabelle/
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Annabelle_(doll)