প্রথমবারের মত স্বতন্ত্র অণুতে বন্ধন পুনর্বিন্যস্ত করলেন বিজ্ঞানীরা
রাসায়নিক বিক্রিয়া আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দৈনন্দিন সব কাজকর্ম জুড়েই আছে নানান কেমিক্যাল রিয়েকশন। এমনকি আমরা যে বেঁচে আছি, তাও অসংখ্য কেমিক্যাল রিয়েকশনের ফলাফল। জীবজগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রক্রিয়া- সালোকসংশ্লেষণ এবং শ্বসনও রাসায়নিক বিক্রিয়া। এক কথায় বিক্রিয়া ছাড়া সবকিছুই অচল।
রাসায়নিক বিক্রিয়া অনেক ধরনের। তবে সাধারণ বিক্রিয়া কীভাবে হয় তা আমাদের সবারই কম-বেশি জানা। এক বা একাধিক আলাদা কেমিক্যালকে একটি পাত্রে রেখে দেই, তাপ দেই, প্রভাবক ব্যবহার করি, ফলাফল হিসেবে তারা বিক্রিয়া করে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদ উৎপন্ন করে। বিক্রিয়কের অসংখ্য অণু নিজেদের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে নতুন যৌগ তৈরি করে। পুরোনো বন্ধন ভাঙে, নতুন বন্ধন গঠিত হয়।
এটি একটি সাধারণ বিক্রিয়ার ক্রিয়াকৌশল।
কিন্তু আমরা কি এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট অণুর বন্ধন পরিবর্তন করাতে পেরেছি?স্রেফ একটি অণুর?
ওয়েল, এতদিন পর্যন্ত না। তবে কিছুদিন আগে বিজ্ঞানীরা ঠিক এটাই করেছেন। রসায়নের ইতিহাসে এটি এক অভূতপূর্ব সাফল্য। চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে সম্ভব হলো এমনটা।
এই সাফল্য অনেকের সমন্বিত পরিশ্রমের ফল। এই দলে ছিলেন IBM Research Europe, Universidade de Santiago de Compostela এবং The University of Regensburg এর বিজ্ঞানীরা। তাদের গবেষণা এবং তার ফলাফল ইতমধ্যেই বিখ্যাত জার্নাল Science.org এ প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকরা কাজ করেছেন টেট্রাক্লোরোটেট্রাসিন নামক যৌগ নিয়ে৷ যার রাসায়নিক সংকেত C₁₈H₈Cl₄.
কাজটি কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। একটি অণুর আকৃতি অসম্ভব রকমের ক্ষূদ্র, খুব সন্তর্পণে কাজ না করলে মুহূর্তেই হিতে বিপরীত হতে পারত। পুরো প্রক্রিয়ায় তারা সাহায্য নিয়েছেন একটি বিশেষ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের। এর নাম Scanning Tunneling Microscope (STM). বন্ধন ভাঙতে ব্যবহার করা হয়েছে খুবই অল্প মাত্রার, অথচ উচ্চ বিভবের বিদ্যুৎ।
প্রথমে গবেষকদল পরীক্ষাধীন যৌগটিকে একটি পাতলা তামার তারের সাথে যুক্ত করেন। এরপর বিদ্যুৎ প্রবাহের সাহায্যে প্রথমে চারটি C-Cl বন্ধনকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পাওয়া যায় আয়নিত কার্বন পরমাণু এবং মুক্ত ইলেকট্রন। একটি ডাই-র্যাডিক্যাল উৎপন্ন হয়। এরপর উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে মুক্ত ইলেকট্রনগুলোর সাহায্যে নতুন C-C বন্ধন তৈরি করা হয়৷ এবং পাওয়া যায় একটি সাইক্লিক অ্যালকাইন রিং- সাইক্লোবিউটাডাইইন।
পুরো প্রক্রিয়াটিকে সহজে বোঝানোর জন্য গবেষকরা একটি উপমা তুলে ধরেছেন৷ ছোটবেলায় আমরা অনেকেই ব্লক নিয়ে খেলেছি। অনেকগুলো ব্লককে একে অপরের সাথে ইচ্ছেমত জুড়ে যেকোনো স্ট্রাকচার বানানো যায়। এগুলোকে বলা হয় Lego.
রাসায়নিক বিক্রিয়া যেভাবে হয়, তাতে আমরা এক বা একাধিক মৌল বা যৌগকে একসাথে পাত্রে রেখে দিয়ে বিক্রিয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করি, এবং তাদের অসংখ্য অণু-পরমাণু নিজেদের মধ্যে বিন্যাসিত হয়ে উৎপাদ সৃষ্টি করে। কিন্তু আমরা চাইলে শুধু একটি নির্দিষ্ট অণুর উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারি না। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, যেন অনেকগুলো ব্লককে ওয়াশিং মেশিনের মত কোনো যন্ত্রে রেখে এমনভাবে ঘোরালাম, যাতে তারা নিজেরা নিজেদের সাথে জুডে গিয়ে একটি নিখুঁত স্ট্রাকচার তৈরি করল যা আমরা বানাতে চাচ্ছি। আমরা চাইলে বাইরে থেকে ব্লকগুলোর ঘূর্ণন নিয়ন্ত্রণ করতে পারব, কিন্তু যেকোনো নির্দিষ্ট দুটি টার্গেটেড ব্লককে নিজেদের মধ্যে জুড়তে পারব না। কারণ অসংখ্য ব্লকের মধ্য থেকে সেটা করা অসম্ভব৷
রাসায়নিক বিক্রিয়াও অনেকটা এমনই। আমরা বিক্রিয়ার পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে অসংখ্য অণুকে বিন্যস্ত করাই। তারা নিজেদের মধ্যে ইলেকট্রন আদান প্রদান, শেয়ার বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে বন্ধন গঠন করে নেয়। কিন্তু আমরা চাইলেই শুধু একটি টার্গেটেড অণুর ভেতরকার বন্ধন পরিবর্তন করতে পারি না। বিজ্ঞানীরা এবার সেই কাজটিই করেছেন।
রাসায়নিক গবেষণাক্ষেত্রে এই গবেষণা নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক। বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে অভাবনীয় সব সাফল্য অর্জন করছেন যা আগে মানুষের কল্পনাতীত ছিল। এমন আরো অনেক কিছুই সম্ভব হবে সুদূর ভবিষ্যতে।
ক্রমণ এগিয়ে যাবে বিজ্ঞান, চলবে বিজ্ঞানের অভিযাত্রা।
References -