প্রাগৈতিহাসিক দানবীয় বিছা

Jaekelopterus

১.
দুপুর ১ টা।

ঘেমে নেয়ে বাইরে থেকে এসেছে তূর্য। গোসল করতে হবে, দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেল সে। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে যখন গুনগুন সুরে মহানন্দে গাইতে গাইতে গোসল শুরু করবে, কোথা থেকে এক বিশাল ভ্রমর ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে। মাথার চারদিকে ঘুরপাক খেতে লাগল। ভয়ে লাফিয়ে উঠল সে, দ্রুত বের হয়ে গেল। তার আর গোসল করা হলো না।

২.
সন্ধ্যা ৭ টা 

চার্জার লাইটের আলোয় পড়ছে তানি। আজ রাতের মধ্যে স্কুল থেকে দেয়া বিশাল অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে হবে, এখনও অনেক বাকি। প্রাণপণে লিখছে সে। হঠাৎ তার টেবিলের উপর আছড়ে পড়ল একটা বড় সাইজের তেলাপোকা। ভয়ে লাফিয়ে উঠল তানি। এরপর পোকাটা উড়াল দিল। তানি দ্রুত লাফিয়ে রুম থেকে বের হয়ে মাকে ডাকতে গেল। মা এসে এই তেলাপোকা না মারলে আজ আর লেখা হবে না তার।

দুটো আলাদা ঘটনা।

কিন্তু প্রেক্ষাপট একই। এরা দুজনেই পোকামাকড় ভীষণ ভয় পায়। এমন ঘটনা আমাদের অনেকের সাথেও প্রতিনিয়ত ঘটে। এদের মত আমরা অনেকেই আছি, যারা পোকামাকড় দেখলেই লাফিয়ে উঠি ভয়ে।
Entomophobia বলে এই জিনিসটাকে। 

এই বিরক্তি জাগানো পোকাগুলো কিন্তু প্রাণীজগতের বড় জায়গা দখল করে আছে। সবচেয়ে বড় পর্বের অন্তর্ভূক্ত তারা। যেটার নাম আমরা সবাই জানি।

আর্থ্রোপোডা।

প্রাণীজগতের সবচেয়ে বিচিত্র পর্ব। ছোট ছোট সাইজের এই জীবগুলো প্রাণীজগতে একটা বিশাল স্থান দখল করে আছে। অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে যেমন কিউট কিউট প্রাণী রয়েছে যেগুলোকে আমরা ভালোবাসি, তেমন কুৎসিত ও ভয়ানক প্রাণীও রয়েছে যাদের আমরা অনেকেই ভয় পাই।

যে ছোট প্রাণীগুলো দেখে এত ভয় পাই, তাদের পূর্বপুরুষরা ছিল আরো ভয়ানক ও বিশাল। আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে বাস করত তারা। তাদের সামনে পড়লে আমার মত Entomophobe দের নিশ্চিতভাবে হার্ট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে।

চলুন পরিচয় করিয়ে দিই এমন এক দানবের সাথে। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থ্রোপোড, Jaekelopterus. প্রাগৈতিহাসিক যুগের দানব সমুদ্র বিছা।

দৈতাকার জায়েকিলোপ্টেরাস বাস করত আজ থেকে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে ডেভোনিয়ান পিরিয়ডে। এই সময়টাকে বলা হয় মাছের স্বর্ণযুগ। তখন পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গা জুড়ে ছিল বিশাল সমুদ্র। সেই সমুদ্রে চষে বেড়াত নানা অদ্ভূত প্রাগৈতিহাসিক জীব, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল Eurypterid বা সি স্করপিয়ন। বর্তমান যুগের কাঁকড়াবিছেদের মত দেখতে, কিন্তু বৈশিষ্ট্যে অনেক আলাদা এই বর্গটির জীববৈচিত্র‍্য ছিল দেখার মত। একটা পেপার ক্লিপের সাইজের আলকিনোপ্টেরাস থেকে সবচেয়ে বিশাল আর্থ্রোপোড জায়েকিলোপ্টেরাস পর্যন্ত এই দলে আছে।

আজকের যুগের ছোটোখাটো ২-৩ ইঞ্চি লম্বা স্করপিয়নও অনেক বিষাক্ত হয়। এদের মধ্যে অনেকেই আপনাকে এক কামড়েই ছবি করে দেয়ারও ক্ষমতা রাখে। তাই বিছাদের ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। ছোট্ট এই প্রাণীটিকে দেখে ভয়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষদদের ৮-১৩ ফুট লম্বা Jaekelopterus এর সামনে গেলে কী অবস্থা হতো, চিন্তা করা যায়?  হাঁফ ছেড়ে বাঁচুন, কারণ তারা এখন নেই, আর আপনিও ডেভোনিয়ানে জন্ম নেননি।

শ্রেণিবিন্যাস-

Kingdom:Animalia
Phylum:Arthropoda
Subphylum:Chelicerata
Order:Eurypterida
Superfamily:Pterygotioidea
Family:Pterygotidae
Genus:

Jaekelopterus


ইউরেপ্টিডদের অরিজিন সম্পর্কে ভালো জানা যায় না। কারণ সাইলুরিয়ান বা ডেভোনিয়ানের ফসিল রেকর্ড অরিজিন ভালোভাবে জানার পক্ষে যথেষ্ট নয়। ২০০৭ সালে জার্মানিতে জায়েকিলোপ্টেরাসের ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরো কিছু ফসিল পাওয়া গেছে, কিন্তু তার বেশিরভাগই অসম্পূর্ণ অবস্থায়। এতদূর আমরা জানি যে, ইউরেপ্টিডদের জন্ম হয়েছিল সাইলুরিয়ানের সমুদ্রে। ধারণা করা হয় এরা আর্থ্রোপ্লিউরা থেকে এসেছে। আর্থ্রোপ্লিউরা ছিল প্রাচীন বিলুপ্ত জায়ান্ট মিলিপিড। ইউরেপ্টিডদের অনেকেই বর্তমান যুগের সাধারণ স্করপিয়নের আত্মীয়। সেই সময়ের সমুদ্রে একটা বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছিল তারা।

ইউরেপ্টিডদের শান্তিতে সমুদ্র শাসন করতে দেয়নি সেই সময়কার সমুদ্রে থাকা তাদের অন্যান্য প্রতিযোগীরা। সমুদ্র সয়লাব হতে থাকে বড় বড় মাছ, জায়ান্ট স্কুইডে। কিন্তু ইউরেপ্টিডরাও ছাড় দেওয়ার পাত্র নয়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আরো বড় হলো তারা। এভাবে ডেভোনিয়ান পিরিয়ডে পৃথিবী দেখা পেল তাদের সবচেয়ে বড় সদস্য জায়েকিলোপ্টেরাসের।

জায়েকিলোপ্টেরাস লম্বা হতো প্রায় ১৩ ফুট পর্যন্ত। দানব বিছাগুলোর শরীরের গঠন ছিল মজবুত। শক্ত খোলসে আবৃত শরীরকে চলাফেরা ও সাঁতারে সাহায্য করত পায়ের মত লম্বা উপাঙ্গ। এদের শ্বসন অঙ্গের নাম গিল ট্র‍্যাক্ট। এই জিনিসটার কাজ অনেকটা ফুলকার মত। তাই তাদের পানির নিচে থাকতে হতো। কিন্তু পানির দানবগুলো ধীরে ধীরে মাটিতেও আসতে শুরু করে। এরা ফুসফুসের ন্যায় একটি অঙ্গ বানিয়ে নেয়, সেটার নাম কাইমোপ্ল্যান্টন। যেটার সাহায্যে তারা মাটিতেও চলাফেরা করতে পারত।
শরীরের সামনে থাকা শক্তিশালী দাঁড়া দিয়ে যেকোনো কিছুকে নিখুঁতভাবে কেটে ফেলতে পারত তারা। এই দাঁড়া দিয়ে মাছেদের খপ করে ধরে খেয়ে নিত। 

কিন্তু সব রাজাদেরই একদিন ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়। জায়েকিলোপ্টেরাসের মত বিশাল সাইজের ইউরেপ্টিডরা একসময় হারিয়ে যায়। ডেভোনিয়ানের শেষদিকে বড় বড় বর্মওয়ালা মাছ ও খোলসযুক্ত জায়ন্টা স্কুইডদেরর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে উঠতে পারেনি এরা। ফলে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

কেমন অনুভূতি হবে , যদি ডেভোনিয়ানের মাটিতে বিশাল জায়েকিলোপ্টেরাসের সামনে আপনাকে ছেড়ে দেয়া হয়? ব্যাপারটি নিসঃন্দেহে আপনার জন্য মোটেই উপভোগ্য হবে না। তার বিশাল ধারালো দাঁড়ার সামনে আপনার মাথাটা আস্ত থাকবে কিনা, তার গ্যারান্টি কে দিতে পারে?

References- 





Pbs Eons

সায়েন্সভেঞ্চার- নাঈম হোসেন ফারুকী

Post a Comment

Previous Post Next Post