সমাজবিমুখতা

Avoidant Personality 

মানুষ সামাজিক জীব। একা একা বেশিরভাগ কাজ সে সম্পাদন করতে পারে না। সমাজে সবার সাথে খাপ খাইয়ে, তাল মিলিয়ে চলতে হয়। কোনো না কোনো কাজে তাকে অন্যের সাহায্য নিতেই হয়। অন্যের সাথে তাকে মিশতেই হয়।
এতেই তার দৈনন্দিন কার্যাবলী সুচারু রুপে সম্পাদিত হয়।

কিন্তু এমন কিছু লোক আছে, যারা একা একা থাকতে বেশি পছন্দ করে। সমাজে অন্যান্য মানুষের সাথে খুব কম মিশতে চায়, বা মিশতে ভয় পায়। তারা সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন, কোনো কারণে সামজিক কোনো কাজে যোগদান করতে হলে সেই কাজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তাদের অস্বস্তি হয়, কিংবা তারা ভয় পান। সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চান। এদের অনেককে আমরা সাধারণ ভাষায় ইন্ট্রোভার্ট ডাকি। 

কিন্তু এটি একটি মিসকনসেপশন। প্রথমে এই ভুল ধারণা দূর করা দরকার।
ইন্ট্রোভার্ট আর অসামাজিক বা অমিশুক সবসময় একই বিষয় নয়। ইন্ট্রোভার্টরা হলেন আত্মকেন্দ্রিক। তারা মিশুক বা অমিশুক দুই-ই হতে পারেন৷ কিন্তু তাদের চিন্তাভাবনা হবে সবসময় নিজেকে কেন্দ্র করে। নিজেকেই প্রাধান্য দেন তারা, সবার উপরে। অন্য কারো ব্যাপারে সাধারণত তেমন কোনো আগ্রহ থাকে না তাদের। অন্যের সাথে মিশলেও তারা শুধু নিজের ভালোর কথাই চিন্তা করতে থাকবেন। 
আর আমরা যাদের সচরাচর ইন্ট্রোভার্ট বলে থাকি, তারা আসলে Avoidant বা Antisocial. অর্থাৎ সামাজিকতা এড়াতে চায় যারা। কারো সাথে মিশতে অস্বস্তিবোধ করে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে চায় না, কারো সামনে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারে না। মানুষের মাঝে এরা হাঁসফাস করে।

মনোবিজ্ঞানে এই ধরনের অন্তর্মুখীতাকে একটি বিশেষ নাম দেয়া হয়েছে।
একে বলা হয়-
Avoidant Personality কিংবা Antisocial behaviour.  

অর্থাৎ, এই ব্যক্তিত্বধারী ব্যক্তিরা মানুষকে avoid করতে পছন্দ করেন। হতে পারে তারা ভয় পান, হতে পারে লজ্জা পান অথবা বিরক্ত বোধ করেন। তাদের কেউ কেউ সোশ্যাল ফোবিয়া বা সোশ্যাল এনজাইটিতে আক্রান্ত হন। এর অর্থ হলো, এই সমস্যা অতিরিক্ত হারে বেড়ে গেলে সেটি একটি ডিসঅর্ডারের পর্যায়ে চলে যায়। তখন তারা যেকোনো সামাজিক পরিস্থিতিতে ভয় পান কিংবা প্রচন্ড অস্বস্তিবোধ করেন।

এমন ব্যক্তিত্বের প্রকাশ আমরা প্রতিনিয়তই দেখে থাকি।

উদাহরণস্বরূপ,

আপনার গানের গলা খুবই সুন্দর, দারুণ গান গাইতে পারেন আপনি। কিন্ত যখন কারো সামনে গাইতে বলা হয়, আপনার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোয় না। 

আপনি একজন ভালো শিক্ষার্থী, পরীক্ষার খাতায় গড়গড় করে সব বিদ্যে উগরে দেন। কিন্তু শিক্ষক মহোদয় যখন ক্লাসে সবার সামনে আপনাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন তখন আপনি তার উত্তর দিতে ভয় পান, আপনার পা কাঁপে। সবার সামনে কিছুই বলতে পারেন না।

আপনি নিজে নিজে অনেক কবিতা লেখেন। সেগুলো সুন্দরও হয়, কিন্তু আপনি সেগুলোকে প্রকাশ করেন না। ভয় পান, লোকে কী বলবে?

আপনি খুবই সুদর্শন, কিন্তু  কোনো অনুষ্ঠানে যেতে চান না । সংকোচবোধ করেন। "এত লোকের মধ্যে আমাকে কেমন দেখাবে?" এই ধারণা আপনাকে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে বাধা দেয়।

এসব সমস্যা যখন আপনার জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করবে, তখন বুঝতে হবে আপনি একজন Avoidant বা Antisocial ব্যক্তি।

Avoidant Personality র এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। আমরা আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষই দেখতে পাই, যারা "পাছে লোকে কিছু বলে" এই মতাদর্শ অনুসরণ করেন। তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে চান। চলুন অন্তর্মুখীদের প্রকারভেদ জেনে নেই।

আত্মবিশ্বাসহীনঃ-

এসব ব্যক্তিদের আত্মবিশ্বাস একদম তলানিতে থাকে। এরা প্রচন্ড রকমের নৈরাশ্যবাদী হন। তাদের সৃজনশীলতা রয়েছে, কিন্তু তা লোকসমক্ষে প্রকাশ করতে ভয় পান। তারা নিজের মনেই নিজের সৃজনশীলতাকে চেপে রাখেন। এরা কামিনী রায়ের বিখ্যাত সেই কবিতা "পাছে লোকে কিছু বলে" র চরিত্রের মতই লোক-সমালোচনার ভয়ে সামজিকতা এড়িয়ে চলেন। অন্য দশজনের মধ্যে লোকে তাকে কী বলবে, এই চিন্তায় তারা তটস্থ থাকেন। এসব ব্যক্তিরা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সমাবেশ এড়িয়ে চলেন।

লাজুকঃ-

এমন ব্যক্তিরা সরাসরি মানুষের সাথে কথা বলতে লজ্জা পান। কোনো বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে এদের লজ্জার মাত্রা সর্বোচ্চ হতে পারে। যেমন, অনেক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা বিপরীত লিঙ্গের কারুর সামনে যেতে পারেন না। তারা প্রচুর পরিমাণে লজ্জা পান। আবার কিছু ব্যক্তি সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করতে চান না, বা যোগ দিলেও কোনো মুখ্য ভূমিকায় থাকতে চান না। তারা লজ্জা পান।

আত্মকেন্দ্রিকঃ-

এখানে এসে ইন্ট্রোভার্ট আর অ্যান্টিসোশ্যাল বিহেভিয়ার মিশে যায়। অর্থাৎ অ্যান্টিসোশ্যাল ইন্ট্রোভার্টরা এই শ্রেণির লোক৷ অনেকেই রয়েছেন যারা এতদূর পর্যন্ত লেখাটি পড়ে এসে নিজেদের মাঝে এগুলোর কোনো উপস্থিতি খুঁজে পান নি। তারা অনেকেই এই অংশের সাথে নিজের মিল খুঁজে পাবেন। হ্যাঁ, Avoidant দের মধ্যে এই শ্রেণির লোকই বেশি খুঁজে পাওয়া যায়। এই ধরনের ব্যক্তিরা নিজেকে সর্বোচ্চ উপরে স্থান দেন। তারা অন্যর উপর নির্ভরশীলতা কিংবা অন্যকেন্দ্রিকতা একেবারেই পছন্দ করেন না। স্বতন্ত্র থাকতে ভালোবাসেন। প্রয়োজন ব্যতীত অন্যের সাথে মেলা-মেশা পছন্দ করেন না। এজন্য ব্যক্তিজীবনের এদের বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা থাকে খুবই সীমিত। অর্থাৎ, এরা সংসারের প্রতি অনেকটা বিরাগভাজন হয়ে থাকেন। এসব ব্যক্তিরা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও কারো সাহায্য নিতে পছন্দ করেন না। ফলে একা একা চলতে গিয়ে অনেক সময় ভয়ানক বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তাদের। 

ভীতুঃ-

এই তালিকার সর্বশেষ ক্যাটাগরির ব্যক্তিরা একদম বেচারা প্রকৃতির। এরা ভীষণ ভীতু হন। ভয়ের কারণেই মূলত অনেক কিছু এড়িয়ে চলেন। কোনো সামাজিক সমাগমে নিজেকে জাহির করতে তারা ভয় পান। এদের ভয় সাধারণত বিশেষ ক্ষেত্রে দেখা যায়। বিশেষ কোনো জায়গায় বা বিশেষ কোনো ব্যক্তির সামনে কথা বলতে ভয় পান। যেমন পুরো শ্রেণির সামনে পড়া বলতে ভয় পাওয়া, কোনো সমাবেশে সবার সামনে বক্তব্য দিতে ভয় পাওয়া ইত্যাদি।

উপরিউক্ত লক্ষণগুলো কোনো সাধারণ সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রেও অল্প অল্প দেখা দিতে পারে। তবে এসব লক্ষণগুলো কারো জীবনে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করলে, তার স্বাভাবিক কাজকর্মকে ব্যাহত করলে নিঃসন্দেহে তিনি এই সমস্যাগুলোর  আওতায় পড়েন।

এসব সমস্যার পেছনে কোনো নির্দিষ্ট কারণ থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। কেউ কেউ বংশগতভাবেই এমন হয়। একটু প্রাপ্তবয়স্ক হলেই তাদের এসব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। এই সমস্যা তৈরি হওয়ার কিছু পরোক্ষ কারণও থাকতে পারে। যেমন ব্যক্তিক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা, নিগৃহীতা ইত্যাদি। কোনো ব্যক্তি তার জীবনের কোনো এক ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থ হয়ে নিজেকে আড়াল করে ফেলতে পারে। কোনো কাজ সবার সামনে করে দেখাতে ভরসা পায় না। শারিরীক প্রতিবন্ধকতার কারণেও কোনো মানুষের এই ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন দুর্ঘটবায় পঙ্গু হয়ে বন্ধুবান্ধবের সামনে না আসা, কোনো বিশেষ রোগ যেমন শ্বেতি, কুষ্ঠ ইত্যাদির কারণে নিজেকে আড়াল রাখা ইত্যাদি। কেউ কেউ কোনো ঘটনায় তীব্র আঘাত পেলে নিজেকে অন্য সবার কাছ থেকে আড়াল করতে শুরু করেন। পারিবারিকভাবে একাকী বড় হলেও শৈশব থেকে কোনো ব্যক্তি Avoidant হয়ে যেতে পারেন। এছাড়া আত্মবিশ্বাসহীনতা, BDD(Body Dysmorphic Disorder) ইত্যাদিও অ্যান্টিসোশ্যাল করে তুলতে পারে যে কাউকে। BDD তে যারা ভোগে, তাদের মূলত নিজেকে দেখতে বিশ্রী মনে হয়। এই কারণে তারা মানুষের সামনে যেতে চায় না।

Avoidant রা সাধারণত নিজেই তাদের সমস্যার কথা বুঝতে পারেন। এক্ষেত্রে এই সমস্যা গুরুতর আকারে দেখা দিলে সাইকিয়াট্রিক কনসালটেন্সির প্রয়োজন পড়ে। সমস্যা দূর করার জন্য সোশ্যাল স্কিলস থেরাপি, কগনিটিভ থেরাপি, টকিং থেরাপি এবং গ্রুপ থেরাপিসহ একাধিক চিকিৎসা রয়েছে। এসব থেরাপিগুলোতে সোশ্যাল অ্যাক্টিভিটি শেখানো হয়, সোশ্যাল মাইন্ডেড করে তোলা হয়। তবে কিছু অ্যান্টিসোশ্যাল এতটাই Avoidant হন যে তারা চিকিৎসক ও চিকিৎসাপদ্ধতিকে পর্যন্ত avoid করতে শুরু করেন। তাই সর্বপ্রথমে আগে চিকিৎসার উপরে তাদের বিশ্বাস অর্জন করানো জরুরি হয়ে পড়ে। 
আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যক্তিই তাদের মানসিক সমস্যার প্রতি অত্যধিক অসচেতন থাকেন। অনেক সময় তারা বুঝতে পারেন না বা বুঝলেও কোনো প্রকার চিকিৎসা ও পরামর্শের প্রয়োজনবোধ করেন না। তাদের আশপাশের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাও সমস্যা খেয়াল করলে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। ফলে মানসিক সমস্যা আরো বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় সর্বোচ্চ ভূমিকা থাকতে হবে তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের, বিশেষ করে পরিবারের লোকেদের। পীড়িত ব্যক্তিকে যথেষ্ট পরিমাণে মানসিক সহযোগিতা ও সুপরামর্শ দিলে সমস্যা অনেকটাই কেটে যায়। সকল সমস্যার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
Avoidant দের সোশ্যালি অ্যাকটিভ করে তুলতে হবে, তাদেরকে মিলেমিশে থাকার গুরুত্ব বোঝাতে হবে।

সঙ্গীবিহীন জীবন বড়ই একঘেয়ে। কিন্তু Avoidant বা অ্যান্টিসোশ্যাল ব্যক্তিরা যেন তা বুঝতে চান না। নিজের একঘেয়েমিতার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেন তারা। তাতে তাদের নানামুখী সমস্যায়ও পড়তে হয়। আসলে সকল কাজই তো একা একা করা সম্ভব নয়। তাই আসুন, সবাই মিলে মিলে হাসিখুশি জীবনযাপন করি। নিজেকে যেন Avoidant এ পরিণত না করি আমরা। 

"দশের লাঠি একের বোঝা"- এই বাক্য যেন সবারই স্মরণে থাকে সবসময়।

References -



1 Comments

Previous Post Next Post